
” বাঁশুরিয়া বাজাও বাঁশি
দেখিনা তোমায়
গেঁয়ো সুর ভেসে বেড়ায় oi
শহুরে হাওয়ায় ”
( কবীর সুমন )
আজ থেকে প্রায় ৭০০ বছর আগে জার্মানির ছোট্ট শহর হ্যামিলিন-এ ঘটেছিল এক চমকপ্রদ ঘটনা । হ্যামিলিনের গির্জার দেওয়ালে আঁকা ছবি থেকে প্রথম এ ঘটনার কথা জানতে পারে মানুষ । পরে এ নিয়ে অনেক গল্পগাথা তৈরি হয় । অনেকেই বলেন এ ঘটনা মোটেও সত্য নয় । গোটা ব্যাপারটাই প্রতীকী । কেউ বলেন গোটাটাই রূপকথা । যাই হোক , মূল গল্পে আসা যাক ।
৭০০ বছর আগে জার্মানি এত আধুনিক ছিল না । হ্যামিলিন ছিল জার্মানির হ্যানোভারের ৩৩ মাইল দক্ষিণে অবস্থিত একটি ছোট্ট শহর । এক সময়ে সেই শহরের মানুষ ইঁদুরের উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে । সেখানে ইঁদুরবাহিত রোগ যেমন মহামারীর আকার ধারণ করে , ঠিক তেমনি ইঁদুরের অত্যাচার দিন দিন বাড়তেই থাকে । শেষে কোনো উপায়ান্তর না দেখে হ্যামিলিন শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ইঁদুরের উৎপাত থেকে বাঁচতে পৌরসভায় জরুরি মিটিংয়ের আয়োজন করেন । এখানে মেয়রের নেতৃত্বে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন যে , শহরকে ইঁদুরের অত্যাচার থেকে যে রক্ষা করতে পারবে তাকে মোটা অংকের পুরস্কার দেওয়া হবে।
সেই ঘোষণায় সাড়া দিয়ে শহরে হাজির হলো এক রহস্যময় বাঁশিওয়ালা । মহামান্য মেয়রের অনুমতি নিয়ে সে বাজাতে শুরু করলো বাঁশি । বড়ো অদ্ভুত সেই বাঁশির সুর । আর কি আশ্চর্য ! সেই সুর শুনে অসংখ্য গর্ত থেকে বেরিয়ে আসতে লাগল হাজার হাজার ইঁদুর । বাঁশি বাজাতে বাজাতে চলতে শুরু করলো বাঁশুরিয়া । আর তার পিছনে পিছনে চললো শহরের সমস্ত ইঁদুর । বাঁশির সুরের মায়াজালে যেন মোহাবিষ্ট রাশি রাশি ইঁদুরের পাল । একসময় ইঁদুরগুলোকে নিয়ে ওয়েজার নদীতে নেমে গেলো সেই বাঁশিওয়ালা । কিছুক্ষণ পরে যখন সে জল থেকে উঠে এলো ততক্ষণে সমস্ত ইঁদুর মারা গেছে । এরপর মেয়রের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পুরস্কার চাইতে গেলে মেয়র ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ সকলেই মুখ ফিরিয়ে নিলেন । পুরস্কারের কথা যেন মনেই পড়লো না তাঁদের । ব্যথিত হতাশ বাঁশিওয়ালা কানাকড়িও না পেয়ে ফিরে গেল একরাশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তার মনে জেগে উঠলো প্রতিশোধস্পৃহা ।
এর কিছুদিন পর এক ধর্মীয় উৎসবের দিনে শহরের বড়োরা যখন গির্জায় জমায়েত হয় সমবেত প্রার্থনার জন্য , সেই সুযোগে বাঁশিওয়ালা এসে বাজাতে শুরু করে তার মোহন বাঁশি। সেই অদ্ভুত সুরের টানে ছুটে আসে শহরের প্রায় সব শিশু। তারা হাঁটতে থাকে সেই বাঁশিওয়ালার পিছু পিছু । তাদের নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শহরের বাইরে চলে যায় বাঁশিওয়ালা । একসময় শিশুদের নিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায় সে । এই মর্মান্তিক ঘটনার পর হাহাকার নেমে আসে শহরে । কেউ বলেন , শহরের বাইরে কোপেলবার্গ পাহাড়ের গুহায় অদৃশ্য হয়ে যায় বাঁশিওয়ালা। কেউ বলেন , ইঁদুরগুলোর মতোই হাল হয় শিশুদের । এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে অনেক ।
আরেকটা মতবাদ অনুসারে , বাঁশিওয়ালা যখন শিশুদের নিয়ে রওনা দেয় তখন কারোরই কিছু করার ছিল না। কারণ , সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে বাঁশির সুর শুনছিল। তারা আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল সবাই , এমনকি স্বয়ং মেয়র পর্যন্ত । মায়াবী সুরের মোহজাল বিছিয়ে যখন বাঁশিওয়ালা শিশুদের নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলো তখন বাধা দেওয়ার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে সবাই । কে আর বাধা দেবে তখন ? শিশুরা বাঁশিওয়ালাকে অনুসরণ করছিল মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে । একসময় শহর ছাড়িয়ে বাঁশিওয়ালা একটা পাহাড়ের দিকে চলে যায় । এবার পাহাড়টা নাকি হঠাৎই দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় ।
তখন সেই আশ্চর্য পাহাড়ের সঙ্কীর্ণ গলি দিয়ে শিশুদের নিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায় বাঁশিওয়ালা । অনেক খুঁজেও আর কখনও তাদের সন্ধান পাওয়া যায়নি । বলা হয়ে থাকে , ১২৮৪ সালের ২২ জুলাই নাকি ঘটনাটি ঘটে । দীর্ঘকাল অমীমাংসিত এই বিষয়টি নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে ।
হ্যামিলিন শহরের পৌরসভায় রাখা পুরানো কাগজপত্র তন্নতন্ন করে খুঁজেও এ ঘটনার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় নি । হ্যামিলিন শহরে এ সংক্রান্ত একটি জাদুঘর রয়েছে । সেখানে এই রহস্যময় কাহিনীর বর্ণনা-সহ কয়েকটি বই আছে । এক প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান অনুযায়ী , সেই আশ্চর্য বাঁশিওয়ালার বয়স আনুমানিক ৩০ বছর , চেহারা অত্যন্ত সুদর্শন । তার বাঁশিটি ছিল রুপোর তৈরি । যদিও বহু নথি ধ্বংস হয়ে যায় প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে । তবুও যা তথ্য পাওয়া যায় তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে বিস্তর । কেউ কেউ মনে করেন , খুব অসৎ লোক সেই বাঁশিওয়ালা , যে শিশুপাচারের সঙ্গে যুক্ত ছিল। যাই হোক , বর্তমানে হ্যামিলিনে যে পৌরসভা রয়েছে তার নামের অর্থ হলো, ‘ ইঁদুর ধরা লোকের বাড়ি ‘ । এটা নির্মিত হয়েছে ১৬০২ সালে । এর দেওয়ালে বিশ্ববিশ্রুত কাহিনীর কয়েকটি ছবিও আঁকা রয়েছে ।
আরও পড়ুন- সোমবার এসএসসি ২৬ হাজার চাকরি বাতিল মামলার শুনানি, নজর গোটা রাজ্যের
_
_
_