দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া
কেবল শুনি রাতের কড়া নাড়া
‘ অবনী বাড়ি আছো? ‘…
কিংবা,
চাবি তোমার পরম যত্নে কাছে
রেখেছিলাম, আজই সময় হলো —
লিখিও, উহা ফিরৎ চাহো কিনা?
অবান্তর স্মৃতির ভিতর আছে
তোমার মুখ অশ্রু-ঝলোমলো
লিখিও, উহা ফিরৎ চাহো কিনা?
অথবা,
তীরে কি প্রচন্ড কলরব
জলে ভেসে যায় কার শব
কোথা ছিল বাড়ি?
রাতের কল্লোল শুধু বলে যায় —
‘ আমি স্বেচ্ছাচারী। ‘

এইসব অরূপরতন, এইসমস্ত হিরন্ময় পঙক্তিগুলির স্রষ্টাকে বাংলা কবিতার পাঠকেরা খুব চেনেন। তিনি আবহমান বাংলা কাব্যের চিরবিস্ময় শক্তি চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু, উপরোক্ত অমর কাব্যচরণগুলি একত্রে সন্নিবেশিত হয়ে আছে কবির যে কাব্যগ্রন্থটিতে, সেটির নাম : ‘ ধর্মে আছো জিরাফেও আছো ‘।
আশ্চর্য নামকরণ! এই গ্রন্থটির প্রথম প্রকাশকাল আশ্বিন ১৩৭২, ইংরেজি ১৯৬৫ সালের অক্টোবর মাস।
বীক্ষণ প্রকাশ ভবন কর্তৃক প্রকাশিত এই কাব্যগ্রন্থটি কবি উৎসর্গ করেছেন, ‘ আধুনিক কবিতার দুর্বোধ্য পাঠকের হাতে ‘। এই কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই বিভিন্ন কাব্যবাসরে, কবি ও লেখকদের সভা ও সমাবেশে এবং অবশ্যই বাংলা কবিতার নবীন পাঠকবৃন্দের ভাবনা ও আলোচনার পরিসরে অনিবার্যরূপে যে প্রশ্নটি ঘুরে বেড়াতো এবং আজ কয়েক যুগ পার করে এসেও যে প্রশ্নটি মাঝেমাঝেই ভেসে ওঠে , তা হলো, কাব্যগ্রন্থের নামটি ‘ ধর্মে আছো জিরাফেও আছো ‘ হলো কেন? ধর্মে আছো হনুমানেও আছো, হলো না কেন? ধর্মে আছো সিংহেও আছো হলে কী ক্ষতি হতো? কিংবা, ধর্মে আছো গাধাতেও আছো লিখলেন না কেন কবি? কেন সব পশু ছেড়ে জিরাফ এখানে বিশিষ্ট হয়ে উঠলো? কোনো একজন কবির বিশেষ কোনো একটি কবিতা নিয়ে এবং কোনো একটি বিশেষ কবিতার অন্তর্নিহিত অর্থ নিয়ে বছরের পর বছর ধরে কাব্যপ্রেমীদের মধ্যে আলোচনা চলতেই থাকে সে উদাহরণ তো অনেক আছে।কিন্তু, কোনো একটি বিশেষ কাব্যগ্রন্থের নামের উৎস সন্ধানে পাঠকের তীব্র কৌতূহল ও অন্বেষা পঞ্চাশ বছর অতিক্রম করেও ক্লান্তিহীন, এমন উদাহরণ কোনো ভাষার সাহিত্যেই সম্ভবত খুব বেশি নেই।

এবার আসা যাক সেই আলোচনায়, যেখানে ‘ ধর্মে আছো জিরাফেও আছো ‘ নামকরণের অর্থ কি হতে পারে এবং অন্য সমস্ত পশুদের হটিয়ে জিরাফ কেন বিশিষ্টতা অর্জন করলো কবির ভাবনায়। প্রায় ছাপ্পান্ন-সাতান্ন বছর ধরে অনেকেই অনেক উত্তর দিয়েছেন নিজের নিজের মতো করে এই প্রশ্নের এবং অবশ্যই সদুত্তর খোঁজার চেষ্টায় ত্রুটি রাখেন নি।
উত্তরগুলি এইরকম : ‘ ধর্মে আছো জিরাফেও আছো ‘ মানে, ভালোতেও আছো খারাপেও আছো, এদিকেও আছো ওদিকেও আছো, অপরিবর্তনেও আছো পরিবর্তনেও আছো, ঝালেও আছো অম্বলেও আছো, ধর্মেও আছো অধর্মেও আছো ইত্যাদি।
আরও কিছু উত্তর যুক্তি ও ব্যাখ্যাসহ উপস্থাপিত হয়েছে। যেমন, জিরাফের গলা অমন লম্বা হয়েছে অভিব্যক্তির কারণে। অর্থাৎ, বিবর্তিত হয়ে আজকের জিরাফ এসেছে। কিন্তু, ধর্মের কোনো বিবর্তন হয় নি, প্রাচীন যুগেও যা ছিল, আজও তাই-ই রয়েছে। এমন যুক্তিও রয়েছে যে, এই শব্দবন্ধের উৎস আদৌ ভারতীয় নয়। জিরাফের লম্বা গলা ডারউইনের এভল্যুশন তত্ত্বের চাক্ষুস প্রমাণ। কিন্তু তা, বাইবেলের creationist মতবাদের বিপরীতে। তাই, ধর্মে আছো জিরাফেও আছো — শব্দবন্ধের অর্থ সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী দুই তত্ত্বকে একইসঙ্গে সমর্থন করা। ধর্ম হলো অবিবর্তনের প্রতীক, যা অপরিবর্তনীয়। কিন্তু, জিরাফ বিবর্তনবাদের প্রতীক, যার প্রমাণ এর লম্বা গলা, আর, বিবর্তন মানেই সময়ের পরিবর্তন। অর্থাৎ, এই প্রবাদের অর্থ, পরিবর্তনেও আছো অপরিবর্তনেও আছো।

অবিজ্ঞানেও আছো বিজ্ঞানেও আছো। পরিশেষে, এ নিয়ে একটা মজার গল্প উল্লেখ না করলেই নয়। কথিত আছে যে, জয়পুরের মহারাজ একবার জাহাজে করে আফ্রিকা থেকে একটি জিরাফ আনান তাঁর চিড়িয়াখানার জন্য। এইরকম অদ্ভুতদর্শন বিশাল আকৃতির জীবের কথা তার আগে কেউ শোনেও নি, দেখা পাওয়া তো দূরের কথা! জয়পুর এবং আশপাশ থেকে মানুষ দলে দলে ভীড় জমাতো সেই অদ্ভুত দর্শন জন্তুটি দেখতে। আশেপাশের দেশীয় রাজারা সম্ভবত ঈর্ষান্বিত হয়েই সপারিষদ ধর্মের দোহাই দিয়ে রটিয়ে দেয় যে, এইরকম কদাকার কোনো জীবের উল্লেখ কোনো ধর্মগ্রন্থেই নেই। অতএব, এই জন্তুটি ঈশ্বরের সৃষ্টি নয়, শয়তানের সৃষ্টি। এই জন্তু দেখা মহাপাপ। একে দেখলে নরকে বা দোজখে যেতে হবে। এই ফতোয়াতে প্রথম দফায় দর্শনার্থীর সংখ্যা অনেকটা কমে গেলেও আস্তে আস্তে আবার মানুষজন ভীড় জমাতে লাগলো। মানুষের কৌতূহল অনেক সময়ই ধর্মীয় ফতোয়াকে পিছনে ফেলে দেয়। তখন জয়পুরের মহারাজ একটু চালাকি করে রাতের দিকেও অনেকক্ষণ চিড়িয়াখানা খোলা রাখার ব্যবস্থা করলেন। ক্রমশঃ দেখা গেল যে সব ধর্মের ধ্বজাধারী দিনের বেলায় জিরাফবিরোধী ফতোয়ার কথা ধর্মস্থানে ভক্তদের মধ্যে প্রচার করে, তারাই আবার রাতের অন্ধকারে চুপিচুপি সপরিবারে জিরাফ দেখতে চিড়িয়াখানায় যায়! এমন ভন্ড মৌলবাদীদেরই জয়পুরের লোকেরা বলতো, ব্যাটারা দিনের বেলায় ধর্মে আছে রাতের বেলায় জিরাফে।
আরও পড়ুন- Alipore Zoo: গরম থেকে রেহাই পেতে দইভাত, লস্যির ডায়েটে ভাল্লুক-শিম্পাঞ্জিরা



































































































































