
‘জেনো এ আমার মাটি, এ কাল আমার দেশকাল
জালিয়ানওয়ালাবাগ এবার হয়েছে আরওয়াল…’
তাঁর দেশকাল তাঁকে একমুহূর্তও শান্তি দেয় নি। বরং দশকের পর দশক ধরে তাঁর হাতে তুলে দিয়েছে নিদারুণ বিষে ভরা পাত্র। তিনি দূরে ফেলে দেন নি। পান করেছেন পরম মমতায়। তাঁর নব্বই বছরের আয়ুর অধিকাংশটা জুড়েই কবির নীলকন্ঠ হওয়ার নিরন্তর অনুশীলন। যুগের হুজুগ কেটে গেলে তাঁর কবিতা বাঁচবে কি বাঁচবে না তার পরোয়া তিনি কোনোদিনই করেন নি। যুগের ডাকে, সমকালের কাতর আহ্বানে বারবার সাড়া দিয়েছেন তিনি। তিনি, শঙ্খ ঘোষ, প্রকৃত অর্থেই, ‘ জীবনব্যাপী সাধনানীল কবি।’

তাঁর লেখা শাশ্বত হয়ে উঠবে কিনা তা নিয়ে তাঁর আদৌ কোনো মাথাব্যথা ছিল না। তাঁর রাজ্য, তাঁর রাষ্ট্র, এমনকি তাঁর সাধের পৃথিবী কবির বুকে বারবার এঁকে দিয়েছে লক্ষ লক্ষ ক্ষতচিহ্ন, তিনি হাসিমুখে তা গ্রহণ করেছেন।
সেই দগদগে ক্ষতগুলি কবি তাঁর কবিতায় অতিযত্নে এঁকে গেছেন হৃদয়ছেঁড়া রক্তমাখা শব্দগুচ্ছ দিয়ে।
শঙ্খ ঘোষের মতো অকুতোভয় কবি প্রায় বিরল। কোনো শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষুকে তিনি পরোয়া করেন নি। সমস্ত ইঙ্গিত, সঙ্কেত ও উপমান- উপমেয়দের সযত্নে একপাশে সরিয়ে রেখে সরাসরি আক্রমণ করেছেন রাজ্যের, দেশের, এমনকি সারাবিশ্বের সমস্ত দুর্বিনীত ও অত্যাচারী শাসকদের। ন্যায় ও সত্যের পথ থেকে কখনও সরে আসেন নি। তাঁর বলা দুটি অবিস্মরণীয় শব্দ যথাক্রমে প্রতাপমত্ততা ও প্রতাপঅন্ধতা স্মরণ করুন। কখনো সরাসরি একেবারে কাছাখোলা আক্রমণ, আবার কখনও বা যুক্তিনির্ভর তাত্ত্বিক আক্রমণ।
তাঁর রাজ্য, তাঁর দেশকাল যখন দাউদাউ করে জ্বলছে, তখন আর পাঁচজন ধান্দাবাজ নিরপেক্ষ কবিদের মতো তিনি ঠাণ্ডাঘরের আরামে ও বিলাসে ভাবগম্ভীর সান্ধ্যভাষার চর্চায় মেতে থাকতে ঘৃণা বোধ করেছেন। কবিতাকে অলংকারহীন করে তুলেছেন অনায়াসে সমকালের প্রয়োজনে। তাঁর কবিত্ব বারবার পরাজিত হয়েছে তাঁর অজেয় ও অক্ষয় মনুষ্যত্বের কাছে। তিনি বারবার বৃহত্তর মানবসমাজের স্বার্থে পথে নেমেছেন, এমনকি অনেকবার অসুস্থ শরীর নিয়েও।

বলেছেন, ‘ এত এত গণ্ডি টেনে অনড় করেছো দুই পা / সহজে যা কাছে আসে তাকেই বলেছো শুধু না… ‘
কাকে বলেছেন? কাদের? কবি- সাহিত্যিকদের? রাজনৈতিক নেতাদের? গোটা সমাজকে? সভ্যতাকে? কাকে বলেন নি? কাদের বলেন নি?
এই কবি যুগদ্রষ্টা। জাগ্রত বিবেক। পেশিশক্তির বিরুদ্ধে কলমের লড়াইয়ে অতন্দ্র এক যোদ্ধা। অথচ, ছন্দের ভিতরকার অন্ধকার নিয়ে তাঁর কবিতা আমাদের সামগ্রিক কবিতাবোধকেই নাড়িয়ে দিয়ে যায়!
শঙ্খ ঘোষের কবিতায় গোটা শতাব্দীর সমস্ত মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের ইতিহাস যেন ধরা আছে। আছে দেশেদেশে সমমানসিকতাসম্পন্ন ঘাতক দল, আর, লক্ষ লক্ষ শিশু, নারী ও নিরীহ-নিরপরাধ নিধনের মর্মস্পর্শী ঘটনা। যেমন, তাঁর ‘ বর্ম ‘ কবিতাটি।
‘ও যখন প্রতিরাত্রে মুখে নিয়ে একলক্ষ ক্ষত… ‘ শেষ হচ্ছে এইভাবে, ‘ এত যদি ব্যুহচক্র
তীরতীরন্দাজ তবে কেন / শরীর দিয়েছ শুধু, বর্মখানি ভুলে গেছো দিতে? ‘
পড়তে পড়তে মনে পড়ে না কি, জাতিদাঙ্গা, হত্যা, আউশভিৎস, আরওয়াল, বাথানিয়াটোলা, ইহুদি হত্যা, গ্যাসচেম্বার, তিয়েন আন মেন স্কোয়ার, লছমনপুর বাথে ও বরানগরের ভয়াবহ গণহত্যা?

এসব নিয়ে কবিতা লিখতে হলে কবিকে স্পষ্ট ও তীক্ষ্ম হতে হয়। অলংকারহীনতার সাধনা করতে হয়। কোনো আড়াল রাখা চলে না। সমস্ত আবরণ, আভরণ ও অলংকার সরিয়ে সমাজ ও সভ্যতাকে বাঁচিয়ে রাখতে কবিতাকে নগ্ন হতে হয়। যা এই শতাব্দীতে কবি শঙ্খ ঘোষ ছাড়া আর কেউ বুঝেছেন কিনা কে জানে! এবং, এভাবেই লিখতে লিখতে যে কোনো যুগন্ধর কবির সামগ্রিক আত্মোদ্ঘাটন হয়। কলম থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসে সেই চিরআশ্বাসবিধৃত অমোঘ বাক্যবন্ধ, ‘ দেখো এ মৃত্যুর মধ্যে কোথাও মৃত্যুর নেই লেশ ।
আরও পড়ুন- KKR: জয় দিয়ে আইপিএলের অভিযান শুরু করল কলকাতা নাইট রাইডার্স



































































































































