DNA: জিনের কাঁচি কী জানেন?

0
4

জিনের কাঁচি, শব্দটা শুনতে অবাক লাগলেও যে কোনও জেনেটিক ত্রুটি সারাতে, নিখুঁতভাবে জিন কাটতে এমনকী নতুন সুস্থ DNA সিকোয়েন্সকে জিনোমে প্রতিস্থাপন করতে এর জুড়ি মেলা ভার। লিখছেন প্রিয়াঙ্কা চক্রবর্তী।

আরও পড়ুন: Weather Forecast:শুরুতেই ঝোড়ো ব্যাটিং চালাচ্ছে শীত, মঙ্গলবার মরসুমের শীতলতম দিন

আমাদের নিত্যদিনের কাজে কাঁচির কতই না ব্যবহার, যা বোধ করি গুনে ওঠা মুশকিল। কাপড় কাটা, কাগজ কাটা, কোনও প্যাকেট কাটা আরও কত কী। কিন্তু তাই বলে জিন-এ কাঁচি। সেটা কী করে সম্ভব? আমাদের বংশগতির ধারক ও বাহকেও যদি কাঁচি চলে তা আমাদের পক্ষে কতটা ভাল হবে আজকের আলোচনা তা নিয়েই। শুধু তাইই নয়, কেনই বা এই কাঁচির প্রয়োজন পড়ল আর কীভাবেই বা এটি কাজ করে, আমাদের দৃষ্টি থাকবে সেই দিকেও। তবে এই আলোচনা শুরু করার আগে জিন সম্বন্ধে সকলের স্পষ্ট ধারণা থাকাটা কিন্তু একান্ত জরুরি।


জিন কাহিনি
জিন কাহিনি শুরু করতে গেলে আমাদের বেশ কয়েকশো বছর পিছিয়ে যেতে হবে। ১৮৬৫ সালে গ্রেগর জোহান মেন্ডেল মটর গাছের ওপর বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এমন একটি জিনিস বা ফ্যাক্টরের ধারণা দেন যেটি কিনা বংশগত বৈশিষ্ট্য এক জনু থেকে অপর জনুতে সঞ্চারিত করতে পারে। কিন্তু এই ফ্যাক্টরটি যে জিন তা তিনি বলতে পারেননি। তবে বংশগত বৈশিষ্ট্য সঞ্চরণের এরকম ধারণা সর্বপ্রথম সবার সামনে তুলে ধরার জন্য তাঁকে ‘ফাদার অফ জেনেটিক্স’ নামে ভূষিত করা হয়। পরবর্তীকালে ওঁর এই ধারণা তথা গবেষণার ওপর ভিত্তি করে জোহানসেন আরও বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার দ্বারা ১৯০৯ সালে, মেন্ডেলের এই সঞ্চরণশীল ফ্যাক্টরটি যে জিন সেটি সবার সামনে আনেন। গ্রিক শব্দ জেনোস (যার অর্থ বংশ) থেকে উৎপন্ন এই শব্দ জিনের অবস্থান ও সঞ্চরণের পদ্ধতি সম্বন্ধে জানতে গেলে আমাদের সর্বাগ্রে DNA বা ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড সম্বন্ধে জেনে নিতে হবে। কারণ এটি ছাড়া জিনের ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব নয়। বলাবাহুল্য DNA-র এই ধারণাটিও কিন্তু ধাপে ধাপে সকলের সামনে আসে। সর্বপ্রথম ১৮৬৯ সালে ফ্রেডরিক মিশের ফেলে দেওয়া ব্যান্ডেজের পুঁজ থেকে নিউক্লিক অ্যাসিডকে পৃথক করেন ও তার নাম দেন নিউক্লেইন। এরপর ১৮৭৮ সালে অ্যালব্রেখট কোসেল এই নিউক্লেইন থেকেই নিউক্লিক অ্যাসিডের (DNA ও RNA) পাঁচটি বেস অর্থাৎ A (অ্যাডেনিন), T (থাইমিন), G (গুয়ানিন), C (সাইটোসিন), U (ইউরাসিল)-কে পৃথক করতে সমর্থ হন। এরও বেশ কিছু বছর পর ১৯২৮ সাল নাগাদ বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে গ্রিফিত জানান যে এই DNA বংশগত বৈশিষ্ট্য সঞ্চরণ করতে পারে। তার এই ধারণাকে ১৯৪৩-১৯৪৪ সাল নাগাদ আভেরি, ম্যাক্লিওড ও ম্যাকার্টি তাঁদের গবেষণার মাধ্যমে সঠিক প্রমাণ করেন। কিন্তু এত কিছুর পরেও যে প্রশ্নটি থেকে যায় সেটি হল, DNA ও জিন কীভাবে সম্পর্কিত? যার উত্তর পাওয়া যায় ১৯৫৭ সালে নোবেল পুরস্কারজয়ী ক্রিকের দেওয়া সেন্ট্রাল ডগমা-র ধারণা থেকে। এখানে একটি কথা বলে রাখা জরুরি বলে আমার মনে হয় সেটি হল, রোসালিন্ড ফ্রাঙ্কলিনের DNA গঠন পর্যবেক্ষণের জন্য করা এক্স রে ক্রিস্টালোগ্রাফির তথ্যই ওয়াটসন ও ক্রিককে DNA–র দ্বিতন্ত্রী গঠনের ধারণা দেয় এবং শুধু তাই-ই নয়, তাঁদের হাতে নোবেল পুরস্কারও পৌঁছে দেয়। এবার আসা যাক সেন্ট্রাল ডগমার কথায়। যেখানে বলা হয়েছে রেপ্লিকেশন পদ্ধতির মাধ্যমে DNA থেকে DNA সৃষ্টি হয়, ট্রান্সক্রিপশন পদ্ধতির মাধ্যমে DNA থেকে RNA (রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড) তৈরি হয়। আবার RNA থেকে প্রোটিন তৈরি হয় ট্রান্সলেশনের মাধ্যমে এবং RNA আবার DNA তৈরি করতে পারে রিভার্স ট্রান্সক্রিপশনের মাধ্যমে। এই রেপ্লিকেশন, ট্রান্সক্রিপশন, ট্রান্সলেশন ও রিভার্স ট্রান্সক্রিপশন সবকিছু মিলিয়েই গড়ে উঠেছে সেন্ট্রাল ডগমা। তাহলে সেন্ট্রাল ডগমার তথ্য অনুযায়ী এটি বলা একেবারেই অত্যুক্তি হবে না যে DNA প্রোটিন তৈরি করতে পারে এবং এর পাশাপাশি আমরা এও জানি যে আমাদের দেহের বেশিরভাগ অংশ প্রোটিন দিয়ে তৈরি। তাহলে এই দুটি তথ্য পরপর রাখলে আমাদের এটি বুঝে নিতে একেবারেই অসুবিধে হয় না যে আমাদের দেহের প্রতিটি খুঁটিনাটি গঠনের জন্য থাকে তার নির্দিষ্ট DNA। তবে আরও নিখুঁতভাবে বলতে গেলে একটি নির্দিষ্ট প্রোটিন তৈরির বার্তা বহন করে একটি নির্দিষ্ট DNA সিকোয়েন্স (A, T, G, C-এর সজ্জা)। আর এই DNA সিকোয়েন্স যা কিনা একটি নির্দিষ্ট প্রোটিন তৈরির বার্তা বহন করে সেটিই হল জিন। আসলে এই জিন হল আমাদের দেহের ব্লু প্রিন্ট। আমাদের দেহ গঠনের জন্য যাবতীয় প্রয়োজনীয় তথ্যাদি সংরক্ষিত থাকে এই DNA-তে আর এই DNA কুণ্ডলিত অবস্থায় থাকে ক্রোমোজোমের মধ্যে। তবে একমাত্র DNA-ই যে জিন হিসেবে কাজ করে তাই নয়, অনেক অনুন্নত জীবের ক্ষেত্রে RNAও জিন হিসেবে কাজ করে থাকে।


CRISPR/Cas-9-জিন কাটে কীভাবে?
CRISPR এর পুরো কথাটি হল ক্লাস্টারড রেগুলারলি ইন্টারস্পেসড সর্ট প্যালিনড্রোমিক রিপিট্স। আর এই Cas-9 হল CRISPR অ্যাসোসিয়েটেড প্রোটিন যেটি কিনা এই কাঁচির কাজটি করে থাকে। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনিফার ডোয়ুডনা এবং বার্লিনের ম্যাক্স প্লাঙ্ক ইউনিটের সদস্যা ইম্যানুয়েল শারপেনটায়ার ২০২০ সালে এই CRISPR/ Cas-9 আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। তাঁরা স্ট্রেপটোকক্কাস পায়োজেনস নামক ব্যাকটিরিয়া থেকে CRISPR/Cas-9 কে পৃথকীকৃত করেন। এই CRISPR আদপে নিজেই একটি DNA সিকোয়েন্স যেটি কিনা Cas-9 এর সহায়তায় যে-কোনও জীবের জিনোম কাটতে বা ছাঁটতে বা বলা ভাল তাদের ত্রুটি সংশোধনে সমর্থ। এই CRISPR/Cas-9 পদ্ধতিটি সর্বপ্রথম এশ্চেরেশিয়া কোলাই নামক ব্যাকটিরিয়ার দেহে পরিলক্ষিত হয়। ব্যাকটিরিয়াগুলি সাধারণত ফাজ ভাইরাসের আক্রমণ থেকে বাঁচতে এই পদ্ধতি অবলম্বন করত। আমরা সবাই প্রায় এই ঘটনাটির সঙ্গে পরিচিত যে ফাজ ভাইরাস ব্যাকটিরিয়ার দেহে নিজেদের জেনেটিক বস্তু প্রবেশ করিয়ে ব্যাকটিরিয়ার জেনেটিক বস্তুর ধ্বংসসাধন করে ও নিজেদের প্রতিলিপি গঠন করে। কিন্তু এই আক্রমণের ফলে অনেক সময় ফাজের জিনের কিছু অংশ ব্যাকটিরিয়ার জিনের অংশীভূত হয় আর এই ব্যাকটিরিয়া যদি কোনওমতে বেঁচে যায় তবে এই ব্যাকটিরিয়াটির ওই ফাজের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে এবং পরবর্তীকালে শত আক্রমণের ফলেও সেই ব্যাকটিরিয়া সেই ফাজ দ্বারা মরে না। এর মূল কারণ হল ব্যাকটিরিয়াটির জিনোম (কোনও জীবের জিনতথ্যের সম্পূর্ণ সেট)-এর প্রকৃতি যেটি আসলে CRISPR-জাতীয় অর্থাৎ সহজভাবে বলতে গেলে এখানে একই প্রকারের A, T, G, C-এর সজ্জাক্রমের পুনরাবৃত্তি দেখা যায় এবং এদের এই সজ্জাক্রমের প্রকৃতি হয় প্যালিনড্রোমিক(উভয় দিক থেকে দেখলে একই সজ্জাক্রম দেখা যায়)। আর এর মাঝে মাঝে কতকগুলি স্পেসার থাকে যা কিনা ওই ফাজের জিন বহন করে বা বলা ভাল যতগুলি ফাজ ওই ব্যাকটিরিয়াকে আক্রমণ করেছে তাদের প্রত্যেকের জিন তথ্যই এই স্পেসাররূপে ব্যাকটিরিয়ার জিনোমে থাকে যা স্মৃতির কাজ করে। শুধু তাই-ই নয়, ব্যাকটিরিয়ার জিনোমে Cas-9 জিনও উপস্থিত থাকে যারা Cas-9 উৎসেচক তৈরি করে। তাই দ্বিতীয়বার কোনও ফাজ আক্রমণকালে যখন তাদের জেনেটিক বস্তুটি ব্যাকটিরিয়ার দেহে প্রবেশ করায় তখন ব্যাকটিরিয়ার দেহে থাকা এই CRISPR-এর স্পেসারের সাথে যদি প্রবিষ্ট জিনের মিল পাওয়া যায়, তাহলে এই CRISPR ওই নির্দিষ্ট সিকোয়েন্সের একটি RNA কপি(crRNA বা CRISPR RNA) তৈরি করে এবং তার সঙ্গে Cas-9 উৎসেচক যুক্ত করে একটি কমপ্লেক্স গঠন করে। যার মধ্যে crRNA ব্যাকটিরিয়া কোষে অনুপ্রবিষ্ট জিনকে চিনতে ও Cas-9 উৎসেচক সেই অংশটিকে চিনে কেটে দিতে সাহায্য করে। ফলে ওই জিনের কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায় ও ব্যাকটিরিয়াটিও ফাজের প্রকোপ থেকে রক্ষা পায়। আবার এই অনুপ্রবিষ্ট জিন যদি নতুন হয় তাহলেও আরেক শ্রেণির Cas প্রোটিন সেই জিনকে কেটে CRISPR-এ সংযোজিত করে। এইভাবে আক্রমণকারী বিভিন্ন ফাজের প্রায় সমস্ত তথ্য ব্যাকটিরিয়াটির CRISPR-এর মধ্যে থেকে যায়। ফাজ ভাইরাসের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা ব্যাকটিরিয়ার এরূপ প্রতিরোধ ক্ষমতা পরবর্তীকালে বিজ্ঞানীদের মাথায় এরকম একপ্রকারের কাঁচির ধারণা দেয় যা দিয়ে কিনা কাঙ্ক্ষিত জিন কাটা যায়।
আগের আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে আমাদের দেহের যাবতীয় গঠনের পিছনে আছে নির্দিষ্ট জিন। তা সে ভালই হোক বা খারাপ অর্থাৎ কোনও রোগের জন্যও দায়ী সেই জিনই(বিশেষত জিনগত রোগ)। তাহলে আমরা যদি এই অসুস্থ জিনগুলিকে সারিয়ে তুলতে চাই তবে আমাদেরকে জিনের ওই সিকোয়েন্সগুলিকে বাদ দিতে হবে যারা কিনা ওই নির্দিষ্ট রোগের জন্য দায়ী। তার জন্য আমরা এই ব্যাকটিরিয়ার পদ্ধতিই অবলম্বন করব। প্রথমত CRISPR-এর মধ্যে ওই অসুস্থ DNA সিকোয়েন্স-এর সংযোজন করাতে হবে যাতে এর থেকে সৃষ্ট crRNA কোষে গিয়ে সেই অসুস্থ DNA সিকোয়েন্সকে চিনতে পারে। আর দ্বিতীয়ত Cas-9 উৎসেচক দিয়ে সেই নির্দিষ্ট সিকোয়েন্সকে কেটে বাদ দিতে হবে। এর ফলে জিনের ওই অংশে থাকা তথ্য মুছে যাবে এবং ওই জিনটি তার কার্যক্ষমতা হারাবে। ফলে সেটি আর কোনও অসুস্থ প্রোটিন তৈরি করতে পারবে না। এখানে একটি কথা বলে রাখা জরুরি সেটি হল CRISPR/Cas-9 পদ্ধতিতে crRNA-এর সঙ্গে একটি ট্রেসার RNA (tracr RNA) থাকে যা কিনা এই crRNA কে ধারণ করতে সহায়তা করে আর এই crRNA ও tracr RNA উভয় মিলেই তৈরি করে গাইড RNA (gRNA) । এই গাইড RNA, Cas-9 কে সঠিক সিকোয়েন্স চিনতে ও তাকে সঠিক জায়গায় কাটতে সহায়তা করে বলেই এরূপ নাম হয়েছে। জিনের এরূপ কাটাকুটির পর হোমোলোগাস রিকম্বিনেশন পদ্ধতি বা ননহোমোলোগাস এন্ড জয়েনিং পদ্ধতিতে এই কাটা অংশগুলি জুড়ে যায়। তাই বলা হয় যে-কোনও ধরনের জেনেটিক ত্রুটি (যেমন-সিস্টিক ফাইব্রোসিস, ক্যানসার, মাস্কুলার ডেসট্রফি প্রভৃতি) সারাতে নিখুঁতভাবে জিন কাটতে, এমনকী নতুন ও সুস্থ DNA সিকোয়েন্সকে জিনোমে প্রতিস্থাপন করতেও নাকি এটির জুড়ি মেলা ভার। বর্তমানে এটির ওপর ভর করেই বিজ্ঞানীরা উন্নত প্রজাতির পতঙ্গ প্রতিরোধী খাদ্যশস্যের পাশাপাশি উন্নত জিনসম্পন্ন মানব ভ্রূণ সৃষ্টি করার কথাও ভাবছেন।