হাইকোর্টে নন্দীগ্রাম- মামলা স্থানান্তরের আর্জিতে মামলাকারী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সংশ্লিষ্ট বিচারপতি কৌশিক চন্দের সঙ্গে বিজেপি’র সম্পর্ক থাকার সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন৷ এই সন্দেহের ভিত্তিতেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ধারনা হয়, এই বিচারপতির এজলাসে তাঁর ‘ইলেকশন- পিটিশন’-এর বিচার নিরপেক্ষ হবেনা৷
বৃহস্পতিবার এই মামলার শুনানি চলাকালীন বিচারপতি কৌশিক চন্দের কিছু মন্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে, বিষয়টি আর ‘সন্দেহ’-র মধ্যে নেই, বিচারপতির সঙ্গে বিজেপির যোগ কতখানি দৃঢ়, এদিন তা ব্যাখ্যা করেছেন বিচারপতি নিজেই৷ কী বলেছেন তিনি :
১) আমি এক সময়ে বিজেপি-র লিগাল সেলের আহ্বায়ক ছিলাম৷
২) ২০১৪ সালে আমি ধর্মতলার ভিক্টোরিয়া হাউসের সামনে বিজেপির সভার অনুমতি আদায় করি মামলা করে৷ ওই সভায় আমি অমিত শাহের সঙ্গে এক মঞ্চে ছিলাম৷ এবং সেদিন আমাকে সম্বর্ধনাও দেওয়া হয়৷
৩) বিজেপির মোর্চা ও সেল রয়েছে। দু’টির কাঠামো আলাদা। আমি যখন বিজেপি-র হয়ে মামলা লড়েছিলাম, তখন বিচারপতি আমাকে বলেছিলেন, কোন দলের? আমি বলেছিলাম, ভারতীয় জনতা পার্টির। তিনি বুঝতে পারেননি। আমি যখন বললাম বিজেপি, তখন তিনি বুঝতে পারলেন।
৪) আমি একাধিকবার আইনজীবী এস এন মুখোপাধ্যায়কে অনুরোধ করেছিলাম আপনি রাজনীতিতে যোগ দিন, অভিষেক মনু সিংভির মতো৷
৫) কেন্দ্রের অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল পদের দায়িত্ব নেওয়ার আগে আমি বিজেপির একাধিক কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছিলাম৷
এজলাসে বসে বিচারপতি কৌশিক চন্দ এদিন নিজেই বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিনি বিজেপির পদাধিকারী ছিলেন এবং বিজেপির প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, প্রেম এখনও অটুট৷ ফলে এই বিচারপতির সঙ্গে বিজেপির সুদৃঢ় যোগাযোগের বিষয়টি আর স্রেফ অনুমান বা সন্দেহের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই৷ বিষয়টি কঠোর বাস্তব ৷
এবং শুধুমাত্র এই কারণেই মামলাকারী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবেদন যুক্তিসঙ্গত ৷ নন্দীগ্রাম- মামলা বিচারপতি কৌশিক চন্দের এজলাস থেকে সরানোর আর্জি জানিয়ে এদিন আদালতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তরফে একাধিক যুক্তি তুলে ধরা হয়,
◾১) মামলাটি বিচারপতি সব্যসাচী ভট্টাচার্যের বেঞ্চে প্রথম মেনশন করা হয় গত ৯ জুন৷ তিনি বলেছিলেন, ১০ জুন মামলাটি শুনবেন৷ কিন্তু হঠাৎ ডিটারমিনেশন বদল হয়ে যায়৷ ১০ জুন চিঠি লেখা হয় প্রধান বিচারপতির সচিবকে৷ এর পর হঠাৎ ১৬ জুন জানা যায় বিচারপতি চন্দের বেঞ্চে এসেছে মামলাটি।
◾২) এই বিচারপতির এজলাসে মামলার নিরপেক্ষ বিচার নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বেঞ্চ বদলের আবেদন জানিয়েছেন ৷
◾৩) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই ‘ইলেকশন-পিটিশন’ বিজেপির শুভেন্দু অধিকারীর বিরুদ্ধে ৷ আর এই মামলার বিচার করবেন প্রাক্তণ বিজেপি পদাধিকারী বিচারপতি চন্দ৷ সলিসিটর জেনারেল পদে নিযুক্ত হওয়ার আগে পর্যন্ত বিচারপতি কৌশিক চন্দ বিজেপির অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন৷ গত ২০১৫ সালের ৯ এপ্রিল তিনি অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল হন৷ তার পরেও, ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি এবং জুলাই মাসে তিনি বিজেপির অনুষ্ঠানে যোগ দেন৷ তাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রুজু করা মামলার বিচারপর্ব এই এজলাসে নিরপেক্ষ হতে পারবে না বলেই আশঙ্কা৷
◾৪) কৌশিক চন্দ কলকাতা হাইকোর্টেই বিজেপির পক্ষে একাধিক মামলা করেছেন আইনজীবী হিসাবে৷ এমন ১০টি মামলার উল্লেখও করা হয়েছে এদিনের শুনানিতে৷
◾৫) সোশ্যাল মিডিয়ায় একাধিক পোস্টে দেখা গিয়েছে কৌশিক চন্দ’র সঙ্গে বিজেপির দুই নেতা দিলীপ ঘোষ এবং তথাগত রায়ের সম্পর্ক আছে৷ তথাগত রায় একাধিক টুইট শেয়ারও করেছেন৷
◾৬) বিচারপতি কৌশিক চন্দ কলকাতা হাইকোর্টের স্থায়ী বিচারপতি এখনও হননি৷ তাঁকে স্থায়ী বিচারপতি করার বিষয়ে হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতামত জানতে চান৷ মুখ্যমন্ত্রী এ ব্যাপারে আপত্তি জানান৷ তাই মামলাকারীর আশঙ্কা, এই আপত্তির কথা কৌশিক চন্দ জানেন৷ এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে ইলেকশন- পিটিশনের বিচারে৷
◾৭) গত ১৮ জুন নন্দীগ্রাম-মামলার প্রথম শুনানি হয় বিচারপতি কৌশিক চন্দ’র এজলাসে৷ তখনই রাজ্যের সাধারণ মানুষ, একাধিক গণ-সংগঠন আশঙ্কা প্রকাশ করে, এই আদালতে নন্দীগ্রাম-মামলার সঠিক বিচার হবে না৷ আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়, এই মামলার বিচার হবে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে, মামলার ‘মেরিট’-এর ভিত্তিতে নয়৷
◾৮) বিজেপির সঙ্গে বিচারপতি কৌশিক চন্দের সম্পর্ক নিছক বিচার বিভাগীয় নয়, মক্কেল-উকিল নয়৷
আগে থেকেই সম্পর্ক ছিলো৷ বিচারপতি চন্দ’র সঙ্গে বিজেপির ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত, পেশাগত, এবং আদর্শগত, একাধিকভাবে তা প্রমানিত হয়েছে৷
◾৯) বিচারপতি কৌশিক চন্দের এজলাসে দাখিল করা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মামলাটি শুধুই রাজনৈতিক মামলা হিসাবে দেখা ঠিক নয়৷ সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে বিজেপি বিভাজনমূলক, আক্রমণাত্মক এবং মেরুকরণের প্রচার করেছে৷ এই দিকটিও দেখা দরকার৷
◾১০) কোনও বিচারপতিই ‘সিজারের পত্নীর মতো সন্দেহের উর্ধ্বে নন’৷ কোনও ব্যক্তিই নিজের বিচারক হতে পারেন না৷ বিচার শুধু করলেই হয়না, বিচার এমন হওয়া উচিত যা দৃশ্যমান হয়৷ এই এজলাসে তা কতখানি সম্ভব, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে৷
◾১১) নন্দীগ্রাম-মামলা যদি বিচারপতি চন্দের এজলাস থেকে সরানো না হয়, তাহলে বিচার- ব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা থাকবে না৷ এমন ঘটনা ঘটলে, তা হবে সমাজের অপূরণীয় ক্ষতি৷
◾১২) সুস্থবোধসম্পন্ন মানুষ আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দায়ের করা নন্দীগ্রাম মামলার বিচার করতে বিচারপতি কৌশিক চন্দ বসবেন “তৈরি করা মন” নিয়ে৷ এই মামলার বিচার রাজনৈতিক দৃষ্টিতে করা হতে পারে, তার ফলে বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের আর ন্যূনতম আস্থা ও শ্রদ্ধা থাকবে না৷
◾১৩) সার্বিক এই পরিস্থিতির ভিত্তিতেই নন্দীগ্রাম মামলাটি বিচারপতি কৌশিক চন্দের এজলাস থেকে সরানোর আর্জি জানিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ বৃহস্পতিবারের শুনানির পর আবেদনকারীর সন্দেহ আরও দৃঢ় হয়েছে৷ এতদিন যেটা আশঙ্কা ছিলো, বিচারপতি কৌশিক চন্দের এদিনের কিছু মন্তব্যে সেই আশঙ্কা এখন বাস্তবে পরিবর্তিত হয়েছে৷ বিচারপতি কৌশিক চন্দ এদিন নিজেই তাঁর বিজেপি-যোগের কথা স্বীকার করে নিয়েছেন৷
আরও পড়ুন- ভুয়ো শিবিরে দেওয়াই হয়নি করোনা ভ্যাকসিন, জানাল কলকাতা পুরসভা



































































































































