কলেজস্ট্রিট পাড়ায় হঠাৎ নক্ষত্র পতন। প্রয়াত মিত্র ও ঘোষের (Mitra And Ghosh) ম্যানেজিং ডিরেক্টর ইন্দ্রানী রায় (Indrani Ray)। বয়স হয়েছিল মাত্র ৫০ বছর। অল্প সময় অসুস্থ ছিলেন তিনি। ক্যান্সার ধরা পড়েছিল একেবারে শেষ পর্যায়ে। ফেব্রুয়ারি মাসে চেষ্টা চলছিল ইন্দ্রানীকে সুস্থ করে তোলার। একই সঙ্গে কাজও চালিয়ে গিয়েছেন তিনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হার মানতে হল।

ইন্দ্রানী রায় শুধু মিত্র ও ঘোষের অন্যতম কর্ণধার ছিলেন না, তিনি ছিলেন কলেজ স্ট্রিটের (College Street) নতুন আঙ্গিকের রূপকার। তাঁর কর্মজীবনের অভিন্নহৃদয় বন্ধু দেব সাহিত্য কুটিরের কর্ণধার রূপা মজুমদার (Rupa Mujumder) জানান, কলেজ স্ট্রিটের অচলায়তনে পুরুষতান্ত্রিকতাকে ভেঙে তিনি এবং ইন্দ্রানী এক নতুন রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। বইপাড়ায় একটি কর্পোরেট লুক আনার চেষ্টা ছিল তাঁদের। রূপা বলেন, শুধুমাত্র মিত্র ও ঘোষ-এর কর্ণধার হিসেবে নয়, ইন্দ্রানীর অবদান কোনওদিন ভুলবে না কলেজ স্ট্রিট। করোনা-লকডাউনের (Corona-Lockdown) সময় যখন সমস্ত বইয়ের দোকান বন্ধ, সেই সময় একা হাতে কমিউনিটিকে চালিয়েছেন ইন্দ্রানী। ঠেলাচলক, মজুর, বুক বাইন্ডারের জন্য মিড ডে মিলের ব্যবস্থা করেছিলেন সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায়।

তারপর এলো আমফান। প্রবল ঘূর্ণিঝড়-বৃষ্টিতে ভেসে গেল বইপাড়া। পরেরদিন সে দৃশ্য দেখে অনেকেই হয়তো চোখের জল ফেলেছিলেন। কিন্তু ইন্দ্রানী শুধু দুঃখ প্রকাশ করেই থেমে থাকেননি, তিনি বেরিয়ে এসেছিলেন রাস্তায়। ‘বইপাড়া সোসাইটি’ তৈরি করে দেশ-বিদেশ থেকে অনুদান সংগ্রহ করেছেন। একেবারে চেকের মাধ্যমে, ব্যাংক ট্রান্সফার করে স্বচ্ছতার সঙ্গে তহবিল তৈরি করে সেইসব বিক্রেতাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন যাঁদের একেবারেই ছোট দোকান, যাঁদের রেজিস্ট্রেশন নেই, এমনকী নেই ট্রেড লাইসেন্স।
শুধু প্রথিতযশা সাহিত্যিকরা নন, নতুনদের সুযোগ দিতেন ইন্দ্রানী। একেবারে ছোটদের জন্য তৈরি করেছিলেন ‘বই বন্ধু’। সেই ‘বই বন্ধু’ নিয়ে প্রত্যন্ত গ্রামেও যেতেন ইন্দ্রানী। লেখকদের নিয়ে গিয়ে গ্রামের স্কুলের গল্প শোনাতেন খুদে পড়ুয়াদের। তাদের দিয়ে গল্প লিখিয়ে সেই পান্ডুলিপি নিজেই দেখে ছেপে বই আকারে প্রকাশ করতেন। বইমেলাকে ছোট আঙ্গিকে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা ছিল মিত্র ও ঘোষের কর্ণধারের। সেই কারণেই নিজের অফিসেই করেছিলেন ‘আঙিনায় বইমেলা’। পাশে ছিলেন বন্ধু দেব সাহিত্য কুটিরের রূপা মজুমদার।
তবে প্রকাশনা সংস্থার কাজ দিয়েই জীবন শুরু হয়নি ইন্দ্রানীর। তিনি ছিলেন সাংবাদিক। কাজ করতেন ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য টেলিগ্রাফ’-এ। সেখান থেকে যান ‘রিডিফ’। ইন্দ্রানীর একসময়ের সহকর্মী পিটিআইয়ের ব্যুরো চিফ জয়ন্ত রায়চৌধুরী (Jayanta Roychowdhury) জানান, সাংবাদিক হিসেবেও ইন্দ্রানী ছিলেন সফল। কেন্দ্রীয়মন্ত্রীদের সফরসঙ্গী হয়ে বিদেশ সফর করেছেন তিনি। কিন্তু মিত্র ও ঘোষের যখন সংকট তখন নিজের সফল ক্যারিয়ার ছেড়ে হাল ধরেন প্রকাশনার। শুধু তাই নয়, নতুনভাবে অন্য আঙ্গিকে সাজান সেটিকে।
এখনও ইন্দ্রানীর নিকটজনেদের স্মৃতিতে তাজা সম্প্রতি ‘মহানগর বইমেলা’তে ইন্দ্রানী রায়ের সক্রিয় অংশগ্রহণ। রয়েছেন ইন্দ্রানীর স্বামী নূর ইসলাম, মেয়ে আকাশ নীলা আর বাবা ভানু বাবু অর্থাৎ সবিতেন্দ্রনাথ রায়। খবর শোনার পর থেকেই সাহিত্যিক থেকে শুরু করে বিভিন্ন মহলের বিশিষ্টজনেরা ইন্দ্রানীকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে হাজির হন তাঁর বাড়িতে। তাঁর অকালপ্রয়াণ মেনে নিতে পারছে না কলেজ স্ট্রিট বইপাড়া।































































































































