‘বিশে ডাকাত’, উৎপল সিনহার কলম

0
1
উৎপল সিনহা

এ ডাকাত সে ডাকাত নয় । বিশ্বনাথ সর্দার ছিলেন বাংলার নীল বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান নেতা । ইংরেজ ঐতিহাসিকেরা তাঁকে ‘ বিশে ডাকাত ‘ নামে আখ্যায়িত করেন । প্রখ্যাত ঐতিহাসিক সুপ্রকাশ রায় তাঁকে মানবদরদী কৃষকবীর বলেছেন । তাঁর দানশীলতা ও বীরোচিত চরিত্রের জন্য তাঁকে ‘ বাবু ‘ সম্বোধনে সম্মানিত করা হয়েছিল । নীলকরদের দ্বারা শোষিত সাধারণ নিম্নবিত্ত অসহায় জনগণ এবং বিশেষরূপে গরীবদের জন্য বিশ্বনাথ সর্দার রাজনৈতিক ডাকাতির পথ অবলম্বন করতে বাধ্য হয়েছিলেন । মানবসেবার এও এক অভিনব পন্থা । এই কাজের সঙ্গে প্রাচীন ইউরোপের রবীনহুডের কাজের যথেষ্ট মিল পাওয়া যায় , যিনি মূলত ধনীদের ধনসম্পদ ডাকাতি করে গরীবদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন ।

বিশ্বনাথ সর্দারকে নীল বিদ্রোহের প্রথম শহীদ হিসেবেও গণ্য করা হয় । তবে এ নিয়ে ভিন্ন মতামতও রয়েছে । ১৮০০ শতকের নীল বিদ্রোহের সাংগঠনিক রূপ দেন বিশ্বনাথ । স্যামুয়েল ফেডি নামক অত্যাচারী নীলকরের বিরুদ্ধে গ্রামীণ হিন্দু-মুসলমান কৃষকদের একত্রিত করে বৃহৎ এক আন্দোলনের সূচনা করেন তিনি । ক্রমে আন্দোলন বড়ো আকার নিতে থাকে । শান্তিপুর এলাকার তাঁত শ্রমিক ও নীলচাষীদের ওপর অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে তিনি শান্তিপুর কুঠি আক্রমণ করে লুঠ করেন , ক্রমান্বয়ে চিত্রশালী নীলকুঠি ও নদীয়া ইন্ডিগো কনসার্নের নীলকর স্যামুয়েল ফেডির কুঠি ধ্বংস করার পর নীলকর গোষ্ঠী আতঙ্কিত হয়ে ওঠে ।

এরপর বিশ্বনাথের নেতৃত্বে একের পর এক সুসংগঠিত আক্রমণে ধুলিসাৎ হয়ে যায় খালি বোয়ালিয়া , নিশ্চিন্তপুর ও বাঁশবেড়িয়া নীলকুঠি । নীলকর স্যামুয়েল ফেডির কুঠি তিনি আক্রমণ করেন ১৮০৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বরের রাতে । গ্রামবাসীরা ফেডিকে বন্দী করে হত্যা করতে চাইলেও বিশ্বনাথের দয়ায় সে যাত্রায়
রক্ষা পান ফেডি এবং সর্বসমক্ষে প্রতিজ্ঞা করেন যে নীলচাষ থেকে বিরত থাকবেন তিনি । যদিও মুক্তি পেয়ে জেলাশাসক ইলিয়ট সাহেবকে এ সংবাদ জানিয়ে দেন ফেডি । এর কয়েকদিন পরেই বিশ্বনাথ সর্দার তাঁর সঙ্গীদের প্রাণরক্ষার্থে ইংরেজ সেনাপতি-সহ পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেন ।

বিশ্বনাথকে হাতে পেয়ে বিচারের নামে প্রহসন শেষ করতে বিশেষ দেরি করে নি বৃটিশ সরকার । তাঁর হত্যা ও হত্যা-পরবর্তী কর্মকাণ্ড ছিল বৃটিশ সরকারের চূড়ান্ত বর্বরতার নিকৃষ্টতম নিদর্শন । বিশ্বনাথকে ফাঁসি দেওয়ার পর তাঁর মৃতদেহটি লোহার খাঁচায় পুরে নদীয়ার কৃষ্ণনগরের নিকটবর্তী আসাননগরের একটি গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয় , যাতে চিল শকুন সেই শব-দেহাংশ খেতে পারে । শাসকদের পরিকল্পনা ছিল বিদ্রোহীর এই বিভৎস পরিণতি দেখে কৃষকরা শঙ্কিত হোক এবং সব ধরনের আন্দোলন থেকে দূরে থাকুক। বিশ্বনাথের মা কঙ্কালটি জলে ভাসিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করলেও নির্মম বৃটিশ সরকার সেই অনুরোধে কর্ণপাত করেনি ।

সাহিত্যে ও ইতিহাসে এই অমর শহীদ পেয়েছেন স্থায়ী আসন । তাঁর সংগ্রাম ও আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার অসামান্য ক্ষমতা এবং সর্বোপরি প্রাণ বিসর্জনকে ঐতিহাসিকেরা যথোচিত সম্মান জানিয়েছেন ।‌ প্রায় একক শক্তিতে বিদেশী বর্বর নীলকরদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের পতাকা উড়িয়ে দরিদ্র কৃষকদের সাহস জোগান বিশ্বনাথ সর্দার । কৃষক আন্দোলনে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয় । ‘ নীলকর এলো দেশে ‘ উপন্যাসে শহীদ বিশ্বনাথের দুর্জয় সাহসের অমর কাহিনী লিপিবদ্ধ করেন শিশু-সাহিত্যিক ধীরেন্দ্রলাল ধর । আজও নীলকরদের অত্যাচারের কথা উঠলেই বিশ্বনাথের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয় ।

আরও পড়ুন- প্রয়াত মদনমোহন বাড়ির রাস চক্রের নির্মাতা আলতাফ মিয়া! শোকপ্রকাশ মুখ্যমন্ত্রীর

_

 

_

 

_

 

_

 

_

 

_