
কে সবচেয়ে জোরে বল করতেন ? ম্যালকম মার্শাল ? অ্যান্ডি রবার্টস ? জেফ টমসন ? শোয়েব আখতার ? ব্রেট লি ? এই প্রশ্নের উত্তরে শচীন তেন্ডুলকার কিন্তু এঁদের কারো নাম করবেন না । বলবেন অন্য আরেকজনের কথা, যাঁর নাম ক্রিকেটবিশ্ব প্রায় ভুলেই গেছে । জেফ ডুজন যাঁকে বলতেন , ‘ quickest of the lot ‘ ।
কে সেই দ্রুততম বোলার ? ১৯৮৭ সালের গ্রীষ্মে যখন মাইকেল হোল্ডিং অবসরে যাওয়ার কথা ভাবছেন , তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজকে তাঁর বিকল্প খুঁজে পেতে হয়রান হতে হয় নি । সেই সন্ধিক্ষণে ম্যালকম মার্শাল তাঁর সেরা সময় পার করে ফেলেছেন , যাঁকে বলা হতো ‘ whispering death ‘ ।
সেই দুরন্ত গতি , যা দেখে ব্যাটসম্যানদের বুক কাঁপতো। হোল্ডিংয়ের ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে লম্বামতো সুঠামদেহী এক তরুণ জ্যামাইকানের অভিষেক হয় ফাস্ট বোলার হিসেবে । জাতীয় দলে অভিষেক হওয়ার আগেই কাউন্টি ক্রিকেটে ল্যাঙ্কাশায়ার আর শেফিল্ড শিল্ডে তাসমানিয়ার হয়ে খেলার ডাক পেয়েছিলেন তিনি। তাঁর বলে ছিল ভয়ঙ্কর গতি । এই বোলারের নাম প্যাট্রিক প্যাটারসন ।
১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে উইজডেন ট্রফি খেলতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে আসে ইংল্যান্ড । জ্যামাইকার সাবাইনা পার্কে প্রথম টেস্টে দুই উদ্বোধনী বোলার মার্শাল আর গার্নারকে বেশ ভালোই মোকাবিলা করলেন ইংরেজ ওপেনাররা । প্রথম পরিবর্তনে এসে হোল্ডিং দেখাতে লাগলেন তাঁর ক্যারিয়ার সমাপ্তির দিকে এগোলেও বিষাক্ত সুইংয়ে একটুও ভাঁটা পড়ে নি । এরপর বল করতে আসেন প্যাটারসন । এর আগে কেউই খেলেন নি তাঁর বল । কানাঘুষা শুনেছেন ইনি নাকি প্রচণ্ড জোরে বল করেন। এবার তাঁর বল খেলতে গিয়ে গ্রাহাম গুচের মতো ঝানু ব্যাটসম্যানও বুঝলেন যে , প্যাটারসন মার্শালের চেয়েও জোরে বল করেন ।
জর্জ হ্যাডলি স্ট্যান্ডের সামনে সাইটস্ক্রিনটা ছিল ছোট । ঠিকভাবে দেখতে অসুবিধা হতো ব্যাটারদের । তার ওপর ছিল ক্যারিবিয়ান বোলারদের উচ্চতা ।
নিজের আত্মজীবনী ‘ হেড অন ‘ – এ স্যার ইয়ান বোথাম লিখেছেন , ‘সাইটস্ক্রিনটা সেদিন লম্বা করে দিলেও প্যাটারসনের বল তেমন আত্মবিশ্বাস নিয়ে খেলতে পারতো না ইংরেজ ব্যাটাররা ‘ । প্রথম ইনিংসে ১১ ওভারে মাত্র ৩০ রান খরচ করে ৪ উইকেট পান প্যাট্রিক । দ্বিতীয় ইনিংসে উইকেট পান ৩ টি । ১০ উইকেটে ম্যাচ জিতে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ । পরের বছর ভারত সফরে এসে ব্যাটসম্যানদের ত্রাস হয়ে ওঠেন প্যাটারসন ।
১৯৮৮ সালে মেলবোর্ন টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজের টেল এন্ডাররা দারুণ লড়াই করছিলেন । স্টিভ ওয়া অনবরত বাউন্সার দিচ্ছিলেন। প্যাট্রিকের ঘাড় লক্ষ্য করে বেশ কয়েকটা বাউন্সার দেন স্টিভ । অল আউট হওয়ার পর প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে অস্ট্রেলিয়ার ড্রেসিংরুমে ঢুকে পড়েন প্যাটারসন এবং হুমকি দিয়ে আসেন , ‘ you guys are going to pay for that tomorrow . I will kill you ‘ ।
পরদিন কথা রাখেন দুরন্ত গতিদানব । একাই গুঁড়িয়ে দেন অজিদের । ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে মাত্র
২৮ টি টেস্ট খেলে ৯৩ টি উইকেট দখল করেন প্যাট্রিক প্যাটারসন । খেলেছেন ৫৯ টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ। এরপর হঠাৎই উধাও হয়ে যান তিনি । ক্রিকেট থেকে , এমনকি নিজের পরিবার থেকেও। কেউ তাঁর খোঁজ পায় না দীর্ঘদিন ।
নব্বইয়ের দশকে স্মৃতির অতল গহ্বরে তলিয়ে প্যাটারসনকে তন্নতন্ন করে খুঁজতে থাকেন দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের সাংবাদিক ভারত সুন্দরেসান । তাঁর নিখোঁজ হওয়া নিয়ে বিস্তর বিতর্ক ছিল । তাঁর পরিবারের লোকেরাও জানতেন না তিনি ঠিক কোথায় এবং কিভাবে আছেন । কেউ বলতো জঙ্গলে চলে গেছেন তিনি । কেউ বলতো মানসিক রোগীদের আশ্রমে আছেন তিনি । আবার কেউ কেউ নাকি রাস্তায় ভবঘুরে উদ্বাস্তুদের মতো ঘুরতে দেখেছেন তাঁকে । শেষে ২০১৭ সালে একজন আমেরিকান নাবিকের সাহায্যে অবিশ্বাস্যভাবে প্যাটারসনের ফোন নম্বর ও ঠিকানার সন্ধান পেয়ে যান সুন্দরেসান ।
সাংবাদিকের ফোন পেয়েও প্যাটারসন কথা বলতে চাইছিলেন না । শেষে তাঁর বাড়িতে পৌঁছে যান সুন্দরেসান। দেখতে পান ঢোলা জামা ও খাকি শর্টস পরা ৫৫ বছর বয়সী বিস্মৃত গতিদানবকে , যিনি ২০ বছর ধরে মানসিকভাবে অসুস্থ । তাঁর ফোকলা দাঁতে অসংলগ্ন হাসি । কথাবার্তাও যথেষ্ট অসংলগ্ন । ক্রিকেট কেন , দুনিয়ার কোনো খবরই রাখেন না তিনি । তাঁর নিজের অতীত জীবনের প্রায় কিছুই মনে নেই তাঁর । নিজের কীর্তির কথা শুনে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন । কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্তের কথা আবছা মনে পড়ে তাঁর । তাঁর বন্ধু মহম্মদ আজহারউদ্দিনের খবর জানতে চান তিনি । ঈশ্বরকে দোষারোপ করেন প্যাট্রিক প্যাটারসন । বারবার বলেন তিনি অবিচারের শিকার । বিড়বিড় করতে থাকেন ‘ injustice , injustice …
হায় গতিদানব , হায় প্যাট্রিক প্যাটারসন ।
আরও পড়ুন- বাড়িতে বাবার মৃতদেহ! পিতৃশোকের মধ্যেই চোখের জল আটকে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিল মুসকান
_