পাঁচ বছর ধরে ‘বিনোদিনী’ হয়ে ওঠার অধ্যাবসায় চালিয়ে যাওয়া সহজ কথা নয়। কিন্তু কার্যত অসাধ্য সাধন করতে পারা মানুষটি ২০২৫-এর বিনোদন দুনিয়ায় যোগ্য ‘বিনোদিনী’। তিনি রুক্মিণী মৈত্র (Rukmini Maitra)। একটা সময় পর্যন্ত বাংলা ইন্ডাস্ট্রি তাঁকে ‘দেবের বান্ধবী’ নামকরণেই সীমাবদ্ধ রেখেছিল। তাই বাংলা থিয়েটারের কিংবদন্তির আত্মকথনের নামভূমিকায় ‘ককপিট’ নায়িকার অভিনয়ের কথা জানতে পারা মাত্রই নিয়ে শুরু হয়েছিল ট্রোলিং। এবার কথায় নয়, কাজে জবাব দিলেন অভিনেত্রী রুক্মিণী। বুঝিয়ে দিলেন বাকি সব কিছুকে বাদ দিয়ে, শুধুমাত্র তাঁর পরিশ্রমের ফসল হয়েই অনবদ্য হয়ে উঠতে পারে ‘বিনোদিনী- একটি নটীর উপাখ্যান'(Binodiini ekti natir upakhyan)।
আদ্যন্ত শহুরে বুদ্ধিদীপ্ত গ্ল্যামারাস নায়িকা হিসেবে হিসেবে পরিচিত রুক্মিণী (Rukmini Maitra)কি অশিক্ষিত, অবহেলিত মেয়েটার সারল্য বা আগুনকে যথাযথভাবে তুলে ধরতে পারবেন? এ প্রশ্ন নিয়ে প্রিমিয়ারে সিনেমা দেখার শুরু। কিন্তু যখন গিরিশ ঘোষের পদতলে সরল অবুঝ এক্সপ্রেশনে “বিনি” হয়ে বসে থাকেন রুক্মিণী, তখন বোঝা যায় কেন অভিনেত্রী বলতে পেরেছেন, “ইস বিনোদিনী মে মেরি জান বসতি হ্যায়”। গল্পে-সিনেমায় যেমন বিনোদিনীকে খাঁটি রত্ন হিসেবে চিনতে ভুল করেননি নাট্যাচার্য, ঠিক সেভাবেই দেব এন্টারটেইনমেন্ট ভেঞ্চার্স এবং প্রমোদ ফিল্মসের এই সিনেমার প্রযোজনা করাকে যথার্থ করে তুলেছেন রুক্মিণী। কুমার বাহাদুরের ( ওম সাহানি এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন) দেওয়া ফুল হাতে নিয়ে রাঙাবাবুর দিকে তাকিয়ে থাকা বিনোদিনী যেভাবে সংশয়ের দোটানাকে অনায়াসে চরিত্রের অংশ করেন অথবা শ্রীরামকৃষ্ণ সংস্পর্শে বদলে যাওয়া জীবনের অনুভবকে চোখ-মুখের এক্সপ্রেশনে ব্যক্ত করেন- তার জন্য অভিনেত্রীর কুর্নিশ প্রাপ্য। প্রত্যেকটা মুহূর্তেই নিজেকে ভেঙে গড়েছেন রুক্মিণী। সিনেমার প্রথমার্ধে ‘বিনি’র বিনোদিনী হয়ে ওঠা যতটা সহজাত মনে হয়েছে, দ্বিতীয়ার্ধের অসহায়তা, আত্মত্যাগ এবং লড়াইয়ের আগুনে ততটাই দৃপ্ত হয়ে উঠেছেন ‘বিনোদিনী’-রূপী রুক্মিণী। প্রিমিয়ারে সিনেমা শুরুর আগেই অভিনেতা প্রযোজক দেব (Dev) বলেছিলেন এই সিনেমা দেখার পর দর্শক চাইবেন দাঁড়িয়ে হাততালি দিতে। সত্যি সত্যিই প্রেমিকের সেই কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলিয়ে দিলেন অভিনেত্রী। আজ থেকে প্রায় ১৪১ বছর আগে নিষিদ্ধপল্লি থেকে উঠে আসা কিশোরীর পক্ষে স্বপ্ন দেখার সাহস জোটানো মোটেও সহজ ছিল না। যেভাবে কাছের চেনা মানুষগুলোর বঞ্চনা আর প্রতারণার শিকার হয়ে একটু একটু করে নিজেকে সবার থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিলেন বাস্তবের বিনোদিনী, বড়পর্দাতেও সেই চলনে একমাত্রাও বেশি গতিবেগ যোগ করেননি পরিচালক রামকমল মুখোপাধ্যায় (Ramkamal Mulherjee)। রামকৃষ্ণ পরমহংস রূপে চন্দন রায় সান্যালকে ভালো লাগে। নিজের কাজ যথাযথ করেছেন মীর আফসার আলি। বিশেষ করে গুরমুখ রায়ের চরিত্রে তাঁর সংলাপ উচ্চারণ বুঝিয়ে দেন তিনি কত উঁচু দরের শিল্পী। তুলনামূলকভাবে ওমের চরিত্র অতটা ফুটে ওঠেনি। স্বল্প পরিসরে নিজের কাজ যথাযথ করেছেন গৌতম হালদার।এই প্রথম সিনেমার জন্য মিউজিক করলেন সৌমজিৎ-সৌরেন্দ্র। ‘হরি মন’ গানের সুর তাল লয় বেশ কিছুটা সময় মনে থেকে যায়। প্রণয় দাশগুপ্তর এডিটিং মন্দ নয়। তবে সেই সময়ের প্রাকৃতিক পরিবেশ তৈরি করার ক্ষেত্রে ক্রোমা শটে আরেকটু স্মার্ট ট্রিটমেন্ট হলে ভালো হতো।
এই ছবি ‘অভিনেত্রী’ রুক্মিণীকে আরও একবার টলিউডের সামনে তুলে ধরল। এই ‘বিনোদিনী’ যেন শুধুই তাঁর। বেশ কিছু জায়গায় কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়কেও টেক্কা দিয়ে গেছেন তিনি। সিনেমার কথ্য ভাষা নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছে কিন্তু এই বিষয়ে পরিচালক এবং অভিনেত্রী দুজনেই জানিয়েছেন যে, এই আত্মজীবনীকে সমসাময়িক করে তুলতেই এই প্রজন্মের দর্শকের গ্রহণযোগ্যতার দিকটাও সমানভাবে গুরুত্ব পেয়েছে। ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে ‘বিনোদিনী-একটি নটীর উপাখ্যান’ ইতিহাসের পাতায় মলিন হয়ে যাওয়া নারী মনের যন্ত্রণার দলিলকে তুলে ধরল। নারী সমানাধিকারের দাবিতে সোচ্চার হওয়া সমাজে, সিনেমার পোস্টারের মুখ্য চরিত্রে এহেন নারীমুখের উপস্থিতি ভাবনা চিন্তার বিপ্লবের ইঙ্গিত দিয়ে গেল। আর এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে সেই কাজটা করার সাহস দেখালো ‘বিনোদিনী -একটি নটীর উপাখ্যান’ ।
–
–
–
–
–
–
–
–
–
–