
” এই বিশ্বে স্থায়ী কিছুই না , এমনকি আমাদের সমস্যাগুলোও না ” ।
” হাসি হলো ওষুধ , যেটা দুঃখ থেকে মুক্তি দেয় ” ।
” সরলতা অর্জন করা কঠিন ” ।
” নিচের দিকে তাকিয়ে আপনি কখনও রংধনু দেখতে পাবেন না ” ।
” আমার জীবনে অনেক সমস্যা আছে , কিন্তু আমার ঠোঁট তা জানে না , তাই সে সবসময় হাসতে থাকে ” ।
” একটা সৃষ্টিশীল কাজের ভেতরে সত্যটা যত গভীর হবে , সেটা তত বেশি সময় টিকে থাকবে ” ।
” আসুন , অসম্ভবের জন্য সংগ্রাম করি , অসম্ভবকে সম্ভব করি , ইতিহাস গড়ি ” ।
” আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু আয়না , কারণ আমি যখন কাঁদি , সে তখন হাসে না ” ।
” আমি বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে হাঁটি যাতে কেউ আমার অশ্রু দেখতে না পায় ” ।
” ক্লোজ আপ-এ জীবন হচ্ছে ট্রাজেডি , কিন্তু লং শটে সেটা কমেডি ” ।
” শিল্প হলো পৃথিবীর উদ্দেশে লেখা এক প্রেমপত্র ” ।
” ভালোবাসা দাও ভালোবাসা ছড়াও ” ।
” শেষে সবকিছুই ঠাট্টা ” ।
এইসব মণিমুক্তো ছড়িয়ে গেছেন যিনি , তাঁর বর্ণময় জীবনে তিনি অসংখ্য ভক্তদের করতালিতে বারবার অভিনন্দিত হলেও দুটি ঘটনা সারাজীবনে ভুলতে পারেন নি । এই মানুষটি শৈশবেই মা ও ভাই-সহ নিজের বাড়ি থেকে বিতাড়িত হন । তাঁর নেশাখোর বাবা তাঁদের বাড়ি থেকে বের করে দেয় । ভীষণ অপমানে , অর্থকষ্টে দিন কাটতে থাকে । তাঁর মা রোজগারের জন্য মঞ্চে গান গাইতেন । প্রচণ্ড মানসিক চাপে ভুগতেন। এমনই এক দিনে মঞ্চে গান গাইতে গাইতে মায়ের গলা ভেঙে গলার স্বর বসে যায় হঠাৎই ।
মাঝপথে গান থেমে যাওয়ায় অধৈর্য শ্রোতারা ক্ষিপ্ত ও উত্তেজিত হয়ে গালাগালি শুরু করেন , স্টেজে ঢিল পড়তে থাকে । এই মানুষটি তখন পাঁচ বছরের শিশু । ছোট্ট ছেলেটি তখন মঞ্চে উঠে তার মায়ের অসমাপ্ত গানটি গাইতে থাকে । শ্রোতারা শান্ত হয়ে শুনতে থাকেন বাচ্চাটির গান । তাঁরা মুগ্ধ হয়ে যান । তুমুল হাততালিতে বাচ্চাটিকে অভিনন্দিত করেন । সেই প্রথম তাঁর মঞ্চে ওঠা । প্রথম দিনেই বাজিমাত ।
তারপর ঘটনাবহুল জীবনের অনেক চড়াই উৎরাই পার হয়ে সেই মানুষটি ১৯৭২ সালে পেলেন একাডেমি পুরস্কার , যাকে বলা হয় অস্কার অ্যাওয়ার্ড । তিনি পুরস্কার নেওয়ার জন্য মঞ্চে উঠতেই সমস্ত দর্শক উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিতে শুরু করেন । হাততালি চলে টানা পাঁচ মিনিট । অস্কার পুরস্কারের ইতিহাসে এটাই এখনও পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ের স্ট্যান্ডিং ওভেশন । আবেগে গলা বুজে আসায় এই অনুষ্ঠানে তিনি বক্তৃতা দিতে পারেন নি । মানুষটির নাম চার্লি চ্যাপলিন।
স্যার চার্লস চ্যাপলিন । পুরো নাম চার্লস স্পেন্সার চ্যাপলিন জুনিয়র ( ১৬ এপ্রিল , ১৮৮৯ — ২৫ ডিসেম্বর , ১৯৭৭ ) । তিনি ছিলেন একজন বৃটিশ চলচ্চিত্র অভিনেতা , পরিচালক ও সুরকার । নির্বাক চলচ্চিত্রের যুগে তাঁর চেয়ে বড়ো মাপের অভিনেতা ও পরিচালক আর কেউ ছিলেন না । তাঁকে বড়োপর্দার সর্বকালের সেরা মূকাভিনেতা বলা হয় । তাঁর মতো বড়ো মাপের কৌতুকাভিনেতাও বিশ্ব চলচ্চিত্রে বিরল । তাঁর বর্ণাঢ্য ব্যক্তিজীবন এবং সামাজিক খ্যাতি ও বিতর্ক দুই-ই নিম্ন থেকে একেবারে শীর্ষবিন্দু ছুঁয়ে গেছে । চিত্রনাট্যকার , প্রযোজক এবং সম্পাদক হিসেবেও তিনি খ্যাতির শীর্ষে আরোহণ করেছিলেন । হাসি তথা রঙ্গকৌতুকের ক্ষমতা কতটা সুদূরপ্রসারী হতে পারে তা বোঝা যায় তাঁর তৈরি সিনেমাগুলো দেখলে । মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিনি সিনেমা জগতে পদার্পণ করেন ।
১৯১৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়ে হলিউড চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হন এবং বড়ো পর্দায় অভিনয় শুরু করেন । অচিরেই তিনি তাঁর স্বসৃষ্ট ভবঘুরে , দ্য ট্রাম্প চরিত্রের মাধ্যমে পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেন । গড়ে ওঠে তাঁর ভক্তকুল । ফ্রান্স , ইতালি , স্পেন ও পর্তুগালে ‘ শার্লট ‘ নামে পরিচিত চ্যাপলিনের ট্রাম্প চরিত্রটি ভবঘুরে হলেও বৃটিশ ভদ্রজনোচিত আদবকায়দায় সুসংস্কৃত ও সম্মানবোধে অটুট । শার্লটের পরনে চাপা কোট , সাইজে বড়ো ঢোলা প্যান্ট , বড়ো জুতো , মাথায় বাউলার হ্যাট , হাতে ছড়ি আর অদ্বিতীয় টুথব্রাশ গোঁফ।
চ্যাপলিন ১৯১৮ সালের মধ্যে বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের মর্যাদা লাভ করেন। তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্র দ্য কিড , দ্য গোল্ডরাশ , দ্য সার্কাস , সিটি লাইটস , মডার্ন টাইমস , মসিয়ে ভের্দু দারুণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে বিশ্বময় । হাসির মোড়কে , ব্যঙ্গ ও কৌতুকের আড়ালে মানুষের দুঃখ-বেদনা , অপরিসীম দারিদ্র্য ও নিঃসীম নিঃসঙ্গতা বারবার প্রকাশ পেয়েছে তাঁর ছবিতে । চূড়ান্ত বৈষম্য ও ভুলে ভরা সমাজব্যবস্থার অজস্র ছিদ্রের দিকে বারবার আঙুল তোলেন তিনি । আসলে তিনি ছিলেন মানবতার একনিষ্ঠ পূজারী । ছিলেন দার্শনিক ও সমাজচিন্তক । তাঁর সবচেয়ে বিতর্কিত চলচ্চিত্রের নাম ‘ দ্য গ্রেট ডিক্টেটর ‘ । যে ছবির বিষয়বস্তু দেখাতে গিয়ে তিনি অতিমাত্রায় রাজনৈতিক হয়ে ওঠেন এবং অ্যাডলফ হিটলারকে ব্যঙ্গ করেন । সমাজতন্ত্রের প্রতি তাঁর অসীম আনুগত্য আছে , এই অভিযোগে তাঁর প্রতি নিষেধাজ্ঞা জারি করে আমেরিকার তৎকালীন সরকার । সেই ক্ষোভে ও প্রতিবাদে আমেরিকা ত্যাগ করেন তিনি । আর কোনদিন আমেরিকায় পা রাখেন নি।
প্রায় ৪০ বছর আমেরিকায় থাকলেও তিনি কখনও মার্কিন নাগরিকত্ব পান নি ।শেষজীবন কাটিয়েছেন সুইজারল্যান্ডে । বিখ্যাত লাইমলাইট ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনার জন্য তিনি অস্কার পুরস্কারে ভূষিত হন । অথচ প্রথাগত সঙ্গীতের কোনো তালিম নেওয়ার সুযোগ কখনও পান নি এই গ্রেট কমেডি কিং । চূড়ান্ত পারফেকশনিস্ট হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি ও কুখ্যাতি দুই-ই ছিল । তাঁর বিখ্যাত সিটি লাইটস চলচ্চিত্রে ভার্জিনিয়া শেরিল-এর বলা একটি সংলাপ পছন্দ না হওয়ায় বারবার রিপিট করতে বলেন। অবশেষে ৩৪২ তম বার বলার পর চার্লির পছন্দ হয় সেই সংলাপ বলা । এইসব আশ্চর্য ঘটনা ঘটিয়েই অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন চার্লস চ্যাপলিন ।
আরও পড়ুন- সুকান্ত মজুমদার কিছু বলবেন? পাসপোর্ট কাণ্ডে বিজেপি নেতা গ্রেফতারের ঘটনায় কটাক্ষ কুণালের
_
_
_
_
_