
মেয়েটি একটার পর একটা সিগারেট ধরায় । ফুঁকতে থাকে , টান দেয় , সুখটান , দুখটান । কখনো অনেকটা টেনে , কখনো বা একটুখানি টেনেই ছুঁড়ে ফেলে সিগারেট । আবার ধরায় নতুন একটা । আবার কিছুটা ধোঁয়া ফুসফুসে নিয়ে ফেলে দেয় অবহেলায় । তৎক্ষণাৎ আরেকটা ধরায় । কখন এত সিগারেট ফোঁকে মেয়েটি ? যখন তার প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে আসে সে । প্রেমিকা ফুসুন । প্রেমিক কেমাল।
‘ দ্য মিউজিয়াম অফ ইনোসেন্স ‘ একটি উপন্যাস । এই উপন্যাসের জন্য নোবেল পুরস্কার পান তুর্কি লেখক ওরহান পামুক । এই উপন্যাসের নায়িকা ফুসুন যখন তার প্রেমিক কেমালের সঙ্গে দেখা করতে আসতো , একটার পর একটা সিগারেট ধরাতো ।
তখন প্রেমিক কেমাল কী করতো ? কেমালের কাজটা আরও অদ্ভুত । প্রেমিকার আধপোড়া লিপস্টিক মাখানো ফেলে দেওয়া সিগারেটের টুকরোগুলো কেমাল অতি গোপনে পরম মমতায় প্রতিদিন সংগ্রহ করে রাখতো প্রেমিকা চলে যাবার পর । ফুসুনের ফেলে যাওয়া সিগারেটের টুকরোগুলো এতো যত্ন করে নিজের সংগ্রহে রাখতো কেন কেমাল ? কারণ , কেমাল মনে করতো , প্রতিটি সিগারেটের টুকরোর মধ্যে তার প্রেমিকার উষ্ণ কোমল ঠোঁটের চাপের তারতম্যের হেতু , প্রেমিকার মেজাজ , স্মৃতি ও আসক্তি জড়িয়ে আছে । প্রেমিকার লালা ও লিপস্টিক মাখানো নানা আকারের সিগারেটের অবশিষ্টাংশগুলি তখন অত্যন্ত মহার্ঘ্য হয়ে উঠতো কেমালের কাছে । এগুলোর মধ্যে দিয়ে প্রেমিকা ফুসুনের বিভিন্ন দিনের ও বিভিন্ন সময়ের মনের হদিশ কিছুটা হলেও পাওয়া যেতো বৈকি ।
তার উদ্বেগ , তার উৎকণ্ঠা , তার ব্যথা-যন্ত্রণা , তার প্রসন্নতা ইত্যাদির চিহ্ন ধরা থাকতো ফেলে দেওয়া সিগারেটের ছোট-বড় অংশগুলোয় । প্রেমিকার বুকের হাপরে কোন বেদনার মায়া বুলিয়ে যেতো তাল তাল ধোঁয়া , তার কিছু হদিশ কি পেতো কেমাল ? পাক আর না পাক , আহা , তবু বেঁচে থাক এমন প্রেম !
এবার সরাসরি পাঠ করা যাক প্রেমিক কেমালের জবানবন্দী ।” কেসকিনে সান্ধ্য খাবার খেতে যাওয়ার আট বছরে , আমি ফুসুনের ফেলে দেওয়া ৪২১৩ টা সিগারেটের অবশিষ্টাংশ জোগাড় করতে পেরেছিলাম । এগুলোর প্রত্যেকটি তার গোলাপী ঠোঁট ছুঁয়েছিলো , আর তার মুখে প্রবেশ করেছিল , এমনকি কয়েকটি তার জিভ স্পর্শ করেছিল আর ভিজে গিয়েছিল । ও সিগারেট নিভিয়ে দেওয়ার পর আমি ফিল্টারে আঙুল রাখলে সেটা বুঝতে পারতাম । সিগারেটের অবশিষ্টগুলি , যা তার সুন্দর লিপস্টিকে লাল হয়ে যাওয়া , এমন কোনো মুহূর্তে তার ঠোঁটের অনন্য ছাপ বহন করছিল , যার স্মৃতি যন্ত্রণা অথবা পরম সুখের ছিল , যা এই অবশিষ্টগুলিকে অনন্য অন্তরঙ্গতার বস্তু করে তুলেছিল … ”
‘ দ্য মিউজিয়াম অফ ইনোসেন্স ‘ উপন্যাসটি পড়তে পড়তে কেমন যেন গুলিয়ে যায় বাস্তব আর অবাস্তবের সীমারেখা । ফেলে দেওয়া সিগারেটের অসংখ্য টুকরো থেকে কীভাবে ভেদ করা যেতে পারে নির্দিষ্ট কোনো একজনের মনের রহস্য , তা এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি । এক অপার্থিব উপলব্ধি যেন । এ কি শুধুমাত্র এক প্রেমিকার মনের জটিল ওঠাপড়ার তথ্য অনুসন্ধান মাত্র ? এ কি ভালোবাসার অতলে তলিয়ে যাওয়ার ছবি নয় ? এ কি টুকরো করে কাছি , প্রেমিকার খোলা হাওয়া পালে লাগিয়ে পাগল প্রেমিকের ডুবতে রাজি হওয়ার অনির্বাণ গান নয় ?
একি স্বপ্ন , একি মায়া ! আর কখন একাকার হয়ে যায় বাস্তব – অবাস্তব – পরাবাস্তব ? এ প্রসঙ্গে গৌতম মিত্র লিখেছেন , ” লেখক নিজেই যদি এমন ভালোবাসায় না ডুবতে পারেন তবে তাঁর সৃষ্ট চরিত্রকে কীভাবে আকণ্ঠ ভালোবাসায় ডোবাবেন ? কাউকে ভালোবাসলে এভাবেই তো দুকূল ছাপানো লাগামহীন উদ্দাম ভালোবাসতে হয় , যাতে বাস্তব ও অবাস্তবের মাঝখানে কোনো কাঁটাতার না থাকে ” ।
জয় কেমাল । জয় ফুসুন ।
জয় ওরহান পামুক ।
আরও পড়ুন- স্বচ্ছতা আনতে কড়া পদক্ষেপ কমিশনের! এবার সেট পরীক্ষার পরীক্ষার্থীদের এডমিটে থাকছে কিউআর