‘মহাকবির মৃত্যু’, উৎপল সিনহার কলম 

0
3
উৎপল সিনহা

মহাকবি কালিদাসের মৃত্যু হয়েছিল কীভাবে ? প্রাচীন জনশ্রুতি , তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল । বিষ খাইয়ে তাঁকে হত্যা করেন তৎকালীন এক অভিজাত গণিকা ।

কিন্তু কেন ? বারবনিতার সঙ্গে মহাকবির যোগাযোগ হয় কী করে ? কোথায় হয়েছিল কালিদাসের মৃত্যু ? মহাকালের প্রাচীন পর্দার আড়াল ভেদ করে যতটুকু জানা যায় তা নিয়েও বিতর্ক আছে বিস্তর । শোনা যায় , নিজের সময়কালে মহাকবি কালিদাসকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন সিলনের ( শ্রীলঙ্কা ) তৎকালীন রাজা কুমারদাসা । রাজা ছিলেন শিল্প ও সাহিত্যের একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক । এহেন রাজার আমন্ত্রণ পেয়ে কালিদাস এক দীর্ঘ ও কঠিন যাত্রাপথ অতিক্রম করে অবশেষে শ্রীলঙ্কায় পৌঁছে একরাতের জন্য কামিনী নামের এক গণিকার আশ্রয়প্রার্থী হন । কামিনী রাজা কুমারদাসার প্রাসাদে গণিকা ছিলেন ।

কথায় কথায় কামিনী কবি কালিদাসকে নিজের একটি ব্যক্তিগত সমস্যার কথা জানান এবং মহাকবির সাহায্য প্রার্থনা করেন । কবি কামিনীকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেন । কামিনী কালিদাসকে জানান যে , তিনি রাজা কুমারদাসার প্রেমে পড়েছেন এবং রাজা তাঁকে বিয়ের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন , কিন্তু সেইসঙ্গে এক কঠিন শর্তও দিয়েছেন ।

সেই পূর্বশর্তটি হলো , স্বয়ং রাজার রচিত একটি অসম্পূর্ণ সংস্কৃত শ্লোককে সম্পূর্ণ করতে হবে কামিনীকে। এই দায়িত্ব যদি পালন করতে পারেন কামিনী , তবেই রাজা তাঁকে বিয়ে করবেন । কিন্তু কামিনী তো কবিতা লিখতে অর্থাৎ শ্লোক রচনা করতে জানেন না । তাই তাঁর পক্ষে অসম্ভব এই কাজটি অত্যন্ত গোপনে যদি কবি কালিদাস দয়া ক’রে করে দেন ( শ্লোকটি সম্পূর্ণ করার কাজ ) তবেই গণিকার কপাল খুলতে পারে এবং রাজার ঘরনী হওয়ার সাধ পূরণ হতে পারে ।

মহাকবির কাছে একটা শ্লোক সম্পূর্ণ করা কোনো কাজের মধ্যেই পড়ে না ।‌ তিনি শ্লোকটি সম্পূর্ণ করেন সেই মুহূর্তেই এবং তুলে দেন কামিনীর হাতে । কামিনী কৃতজ্ঞচিত্তে অজস্র ধন্যবাদ জানান কবিকে ।

কিন্তু পরক্ষণেই কামিনীর মনে একপ্রকার ভয়ের উদ্রেক হয় এই ভেবে যে , রাজার দেওয়া শ্লোকটি সম্পূর্ণ করার গোপন রহস্যটি যদি কোনদিন উন্মোচিত হয়ে যায় রাজার কাছে , যদি রাজা কোনোভাবে কখনো জানতে পেরে যান যে , গণিকা কামিনী নয় , আসলে এই শ্লোকটি সম্পূর্ণ করেছেন মহাকবি কালিদাস , তাও গণিকা কামিনীর অনুরোধে , তাহলে তো মহা অনর্থ ঘটে যাবে । রাজার কাছে চিরদিনের জন্য বিশ্বাসভঙ্গ হবে , গণিকার রাণি হওয়ার সাধ অপূর্ণই থেকে যাবে এবং রাজ্য থেকে বিতাড়িত হতে হবে কামিনীকে । রাজাকে তুষ্ট করতে এমন প্রতারণা ও ছলনার জন্য কঠোর শাস্তি পেতে হবে কামিনীকে । তাহলে উপায় ?

উপায় একটাই । মহাকবিকে মেরে ফেলা । গোপনে কবিকে হত্যার এই পরিকল্পনা করেন কামিনী মিথ্যাকে চিরদিনের জন্য আড়ালে রাখার একমাত্র উপায় হিসেবে । তারপর যেমন ভাবনা তেমন কাজ । বন্ধুত্ব ও পারস্পরিক বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে কবিকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করেন গণিকা কামিনী । এইভাবেই অস্বাভাবিক এক মৃত্যুর শিকার হন মহাকবি কালিদাস । বড়ো মর্মান্তিক এই মৃত্যু ।

তারপর ? তারপরের ঘটনাও কম বেদনাবহ নয় । কবির এমন মৃত্যুর পর অনুশোচনায় ভুগতে থাকেন কামিনী । প্রতিমুহূর্তে জর্জরিত হতে থাকেন চূড়ান্ত অপরাধবোধে।
মরমে মরতে থাকেন গণিকা ।

বুঝতে পারেন মহাকবির প্রতি তাঁর কৃতঘ্নতা এক মহাপাপের সমান । মনে মনে এর প্রায়শ্চিত্ত করার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন কামিনী । নিজেকে শেষ না করে এই অপরাধবোধ থেকে নিস্তার পাওয়া যাবে না বুঝে একদিন আত্মহত্যার পথ বেছে নেন তিনি । সমাপ্ত হয় উচ্চাকাঙ্ক্ষী গণিকার জীবন। এই মর্মান্তিক ঘটনার কথা একসময় জানতে পারেন রাজা কুমারদাসা ।

এই ট্রাজেডিতে তিনি ভীষণ বিমর্ষ ও হতোদ্যম হয়ে পড়েন। জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন রাজা ।মহাকবি কালিদাস এবং গণিকা কামিনীর মর্মান্তিক মৃত্যুর জন্য তিনি দায়ী করতে থাকেন নিজেকেই । শোনা যায় , একসময় রাজা নিজেই নিজেকে শেষ করে দেওয়ার পথ বেছে নেন ।

মহাকবি কালিদাসের মতো বিশ্ববিশ্রুত একজন মানুষের জীবনের অন্তিম পরিণতি যেমন বেদনাবহ , তেমনই রহস্যে মোড়া । তাঁর জীবনের বেশিরভাগ তথ্যই পৌরাণিক কাহিনী এবং কিংবদন্তি থেকে প্রাপ্ত ।

জনশ্রুতি এই যে , কালিদাস খুব অল্প বয়সে তাঁর বাবা ও মাকে হারান । কোনো প্রথাগত বা আনুষ্ঠানিক শিক্ষা তিনি পান নি । তাঁর জন্ম খ্রিষ্টীয় চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দীতে হিমালয়ের কোনো স্থানে অথবা উজ্জয়িনীতে হয়েছিল এমনই অনুমান করা হয় । তিনি ছিলেন কবি ও নাট্যকার । সবচেয়ে জনপ্রিয় তত্ব হলো , দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালে প্রসিদ্ধি লাভ করেন কালিদাস । একটি কিংবদন্তি অনুসারে , এক রাজকন্যার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল কালিদাসের , কিন্তু কবির মূর্খামি ধরা পড়ে যায় রাজকন্যার কাছে এবং চরম অপমানিত হয়ে বিতাড়িত হন কালিদাস ।‌ পরে , মা সরস্বতীর কাছে বরপ্রাপ্ত হয়ে মহাকবি হয়ে ওঠেন তিনি ।

আরও পড়ুন- লুকিয়ে আমেরিকায় ঢুকতে গিয়ে মৃত্যু হয়েছিল গুজরাতের গোটা পরিবারের! অভিযুক্তদের বিচার শুরু সোমবার

‘ আষাঢ়স্য প্রথম দিবস ‘ – কে কালিদাসের জন্মদিন হিসেবে ধরা হয় । মেঘদূতম , রঘুবংশ, কুমার সম্ভব , ঋতুসংহার ইত্যাদি অমর কাব্যগুলির রচয়িতা কালিদাস লিখে গেছেন তিনখানি বিখ্যাত নাটক । সেগুলি হলো , মালবিকাগ্নিমিত্র , অভিজ্ঞান শকুন্তলম এবং বিক্রমোর্বশীয়। তাঁর রচনাগুলিও তাঁরই মতো অবিস্মরণীয় ।