
” উঠে দাঁড়াও , পার্টির বিপদের দিনে ।
জানি তুমি রোগগ্রস্ত ,
কিন্তু পার্টি মুমূর্ষু ,
জানি তুমি দুর্বল , তবু তোমারই সাহায্য চাই ।
উঠে দাঁড়াও , পার্টির বিপদের দিনে ।
জানি তুমি নানা দ্বিধায়
দোদুল্যমান , কিন্তু আজ নেই কোনো দ্বিধার অবকাশ ,
আমরা উপনীত চরম সীমায় ।
জানি দিয়েছো পার্টিকে
বহু অভিশাপ , আজ আর নেই মান অভিমানের সময় ,
পার্টি আজ আক্রান্ত ।
উঠে দাঁড়াও , পার্টির বিপদের দিনে । উঠে দাঁড়াও এক্ষুনি ।
জানি তুমি অসুস্থ , কিন্তু তোমায় দরকার । মরার অনেক সময় পাবে পরে ,
এখন চাই তোমার সাহায্য ।
থেকো না দূরে দূরে ,
লড়াইয়ে যাচ্ছি আমরা ,
উঠে দাঁড়াও পার্টির বিপদের দিনে , উঠে দাঁড়াও । ”
( বের্টোল্ট ব্রেখটের লেখা নাটকের গান ।
নাটক : ডী মুটার , ম্যাক্সিম গোর্কির লেখা ‘ মাদার ‘ নাটকের ছায়ায় রচিত । বিপ্লবী পাভেলের মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছেন তাঁর মা , আর তাঁর উদ্দেশে শ্রমিকদের দল গানটি গাইছেন কোরাসে )
উত্তর ঘুমিয়ে পড়ে । কিন্তু প্রশ্ন জেগে থাকে । জাগিয়ে রাখে পরিপার্শ্বকে । উত্তর নশ্বর , কিন্তু প্রশ্ন অনির্বাণ , অবিনশ্বর। সঙ্কটের কল্পনাতে ম্রিয়মান হয়ে থাকা সময়কে প্রশ্ন । সমকালকে প্রশ্ন । প্রশ্ন বৈষম্যের বিশ্বব্যবস্থাকে । প্রশ্ন ক্রমশ বিলীয়মান মনুষ্যত্বকে ।
মানুষের অস্তিত্বের সঙ্গে প্রশ্নকে গেঁথে দিতে হলে মাধ্যম হিসেবে চাই সুস্থ বিনোদন , যা দিতে পারে থিয়েটার । অসীম এই তিলোত্তমা শিল্পের ক্ষমতা। কবি ও নাট্যকার বের্টোল্ট ব্রেখট তাই তাঁর বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে বেছে নিলেন নাটক । নাচ , গান , স্লোগান , কবিতাকে অভিনয়ের সঙ্গে এতটাই নিপুণভাবে মিশিয়ে দিলেন যে , বিশ্বনাট্যের ধারায় যুক্ত হলো একটি সম্পূর্ণ নতুন নাট্যশৈলী , যা এককথায় অভিনব । তাঁর ‘ এপিক থিয়েটার ‘ বিশ্ববিশ্রুত , বিশ্ববন্দিত ।
মনোরঞ্জন অবশ্যই থাকবে , তবে সেই মনোরঞ্জনের মূল উদ্দেশ্য হবে প্রশ্ন তুলে দেওয়া এবং দেশ , কাল ও সমাজের প্রকৃত ছবি দর্শকদের সামনে নিয়ে আসা । পরিপার্শ্ব নিয়ে মানুষকে ভাবতে বাধ্য করার দায় কাঁধে তুলে নিলেন ব্রেখট। তিনি একাধারে কবি , ঔপন্যাসিক , নাট্যকার , গীতিকার ও সুরকার ।
ব্রেখট বিশ্বাস করতেন যে , একজন অভিনেতার যেকোনো চরিত্রকে এমনভাবে উপস্থাপন করা উচিত যা ছদ্মবেশী নয় , বরং চরিত্রের ক্রিয়াকলাপের বর্ণনা । তিনি মহাকাব্যিক থিয়েটার তৈরি করে ইতিহাসকে প্রভাবিত করার প্রয়াস করেন , যা দর্শকবৃন্দ শুধু বিশ্বাস নয় , উপলব্ধি করবেন । তিনি বলতেন , তত্ত্ব ও প্রয়োগের ভারসাম্য আসে নন্দনতত্ত্বের সঠিক ব্যবহারে ।
কবি বেখট অননুকরণীয় । শম্ভু মিত্রের অনুবাদে ব্রেখটের এই কবিতাটি অবিস্মরণীয় :
” তোমরা যারা এই বন্যার মধ্য থেকে জেগে উঠে দাঁড়াবে —
যে বন্যাতে আমরা সবাই তলিয়ে গেলাম ,
সেই তোমরা যখন আমাদের ত্রুটিগুলোর কথা বলবে
তখন এটুকুও ভেবো
যে কোন্ এক অন্ধকার যুগে আমরা বেঁচেছি
যে অন্ধকার থেকে
তোমরা বেঁচে গেছো । ”
ইউজিন বার্থহোল্ড ফ্রেডরিখ ব্রেখট ( ১৮৯৮ — ১৯৫৬ ) বিশ্ববিশ্রুত জার্মান নাট্যকার , নির্দেশক । তাঁর নাটকে মানবতা ও বিশ্বভ্রাতৃত্বের জয়গানের পাশাপাশি যুদ্ধ , বৈষম্য ও শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে বারবার । নাট্যকার ডেভিড এডগার ব্রেখট সম্পর্কে বলেছেন , ‘ আমরা যে বাতাসে শ্বাস নিই , ব্রেখট তারই এক অংশ । ‘
রাষ্ট্র চিরদিন যাঁকে সন্দেহের চোখে দেখে , তিনি কি যেমন তেমন মানুষ ? কবিতায় , গানে , নাটকে তাঁর নিশানা যুগ-যুগান্তরের মানুষখেকো ব্যবস্থা । তাঁর প্রেম , তাঁর দ্রোহ সবই বিশ্ব-মানবতার স্বার্থে ।
১৯৩৩ সালে নাৎসিদের অত্যাচারে দেশ ছাড়ার পর বাকি জীবনটা প্রায় ভবঘুরের মতো এক দেশ থেকে আরেক দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন ব্রেখট। তাঁর নিজের দেশ বলে কিছু ছিল না । হলিউড কালচার তাঁর পছন্দ হয় নি ।
বহু পথ , বহু দেশ ঘুরে তিনি পূর্ব বার্লিনে আসেন ১৯৪৯ সালে । এখানে তিনি গড়ে তোলেন ‘ বার্লিনার এনসেম্বল’ । ১৯৫৬ সালের ১৪ আগস্ট এখানেই তিনি মারা যান । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন তিনি ছিলেন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে , সেখানে তাঁকে সন্দেহ করা হতো সাম্যবাদী হিসেবে এবং এফ বি আইয়ের নজরদারিতে তাঁকে থাকতে হয় ।
১৯১৪ সালে তিনি রচনা করেন তাঁর প্রথম নাটিকা ‘ দ্য বাইবেল’ । ১৯২০ সালে লেখেন পূর্ণ দৈর্ঘ্যের নাটক ‘ বল ‘ ।১৯২২-এ লেখেন ‘ ম্যান ইকুয়ালস ম্যান ‘ । ‘ দ্য বেগার্স অপেরা ‘ অবলম্বনে তাঁর নাটক ‘ দ্য থ্রি পেনি অপেরা ‘ সারা বিশ্বে আলোড়ন তোলে । নাৎসিদের বর্বর অত্যাচার এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা তাঁর জীবনে ও রচনায় গভীর প্রভাব ফেলে ।
ড্রামস ইন দ্য নাইট , দ্য বেগার , আ রেসপেক্টেবল ওয়েডিং , লিটল মাহাগনি , সেন্ট জোন অফ স্টকিয়ার্ডস, লাইফ অফ গ্যালিলিও , দ্য ট্রায়াল অফ লুকুলাস , দ্য ডেজ অফ দি কমিউন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য নাটকগুলো ব্রেখট তৈরি করেন ১৯১৮ সাল থেকে ১৯৫৩ সালের মধ্যবর্তী সময়ে।
আরও পড়ুন- জাতীয় মঞ্চে পর্দাফাঁস হবে আনন্দ বোসের! স্পীকার সম্মেলনে যোগ বিমানের
মাত্র ৫৮ বছরের আয়ুষ্কালে তিনি বিশ্ব-নাটকের ইতিহাসকে সম্পূর্ণ অন্য খাতে , অন্য ধারায় বইয়ে দিয়ে গেছেন । কবিতা ছিল যাঁর প্রথম প্রেম , কবিতাতেই যিনি খুঁজে পেয়েছিলেন প্রথম আলো , বিপ্লবের সেই চারণকবি ব্রেখটের একটি কবিতাংশের অনুবাদ পাঠ করা যাক এ নিবন্ধের উপসংহারে : ” জানি , তোমরা সবাই চাও যে আমি চলে যাই
তোমাদের পক্ষে একটু বেশিই দেখে ফেলি আমি , ঢের বেশি খাই , বুঝতে পারছি আমার মতো লোকের সঙ্গে চলার রীতিনীতি তোমাদের জানা নেই । কিন্তু মশাইরা , সহজে আমি যাচ্ছি না । সাফসাফ বলছি সবাইকে , ভাগের মাংস সব দিয়ে দাও আমায় । পায়ে-পায়ে তোমাদের অনুসরণ করেছি সর্বদা ।আগেই জানিয়েছি যে চলে যেতে হবে কিন্তু তোমাদেরই , তোমাদের ভাষা আমি মিছিমিছি শিখিনি বাবা ।