‘গ্রেটেস্ট শো’, উৎপল সিনহার কলম

0
3
উৎপল সিনহা

এখন ‘ দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ ‘ চলছে । এ কোনো সিনেমা নয় , তথাকথিত কোনো প্রদর্শনী নয় , আক্ষরিক অর্থেই পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো ‘ শো ‘ চলছে এখন প্যারিসে । প্যারিস অলিম্পিক্স ২০২৪ । ফুটবল বিশ্বকাপকেও কেউ কেউ এ নামে অভিহিত করেন বটে , কিন্তু গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ বলতে অলিম্পিক্সকেই বোঝায় । এমন জৌলুসদীপ্ত ,এমন জাঁকজমকপূর্ণ , বৈচিত্র্যময় , রোমাঞ্চকর খেলার আসর প্রকৃত অর্থেই অতুলন । পৃথিবীর তাবৎ দেশের সেরা ক্রীড়াসাধকেরা এই অসামান্য ক্রীড়াযুদ্ধে অবতীর্ণ হন সিদ্ধিলাভের অভিপ্রায়ে । এখানে সোনা , রুপো কিংবা ব্রোঞ্জের পদক জেতার অর্থ সারা বিশ্বের কাছে নিজের দেশের নাম উজ্জ্বল করা । এখানে সাফল্য পাওয়ার মানে জীবনযুদ্ধে জয়লাভ । আর ব্যর্থ হলে ? সেই ব্যর্থতার গ্লানি , সেই পরাজয়ের যন্ত্রণা মৃত্যুযন্ত্রণার চেয়ে কম কিছু নয় । অলিম্পিকের আসর থেকে শূন্য হাতে ফিরে আসা যেন অভিশাপের মতো । এখানে কেউ কারো নয় । হয় পদক পাও । কিংবা হারিয়ে যাও । হয় অর্জন করো তারকার জৌলুস , অথবা তলিয়ে যাও পতনের অতল অন্ধকারে ।
মনে আছে নিশ্চয় সিমোন বাইলসের কথা। আমেরিকার সেই শৈল্পিক জিমন্যাস্ট , সর্বকালের অলিম্পিক্স রূপকথায় যিনি ইতিমধ্যেই স্থান করে নিয়েছেন । সেই সিমোন বাইলস , যিনি রণে ভঙ্গ দিয়ে টোকিও অলিম্পিক্স থেকে বিদায় নিয়েছিলেন কাঁদতে কাঁদতে , কাঁপতে কাঁপতে । কিন্তু কেন ? কী হয়েছিল তাঁর ? সোজা কথায় , তিনি মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন । মানসিক অবসাদ । এক সাংঘাতিক ব্যাধি , যার সহজ কোনো নিরাময় নেই , যে যন্ত্রণার উপশম হয় না সহজে। বড়ো কঠিন এ রোগ । এ আঁধার থেকে ফেরার পথ ভীষণ বন্ধুর । এই রোগে আক্রান্ত মানুষটিকে গ্রাস করে অন্তহীন এক শূন্যতা । মাথা কাজ করে না । অকারণ ভীতি দুমড়েমুচড়ে ফেলে স্বাভাবিকতা । চরম অবসাদে ডুবে যায় মন । তারকাদের স্টারডম যেমন উপভোগ্য তেমনই বিপজ্জনক ।‌ লক্ষ কোটি ভক্তদের প্রত্যাশা ও চাহিদার ফাঁস কখন যে আষ্টেপৃষ্ঠে বন্দী করে ফেলে তারকাদের , সেটা বুঝতে পারা প্রায় অসম্ভব । এখানে পরাজিত , ব্যর্থদের কোনো ক্ষমা নেই । এই নৃশংস অন্ধকারে হারিয়ে গেছেন এবং হারিয়ে যান কত যে তারকা ক্রীড়াবিদ ! মনের মাঝে বাসা বাঁধা অন্ধকারের গহ্বরে চিরকালের মতো হারিয়ে যান বেশিরভাগই ।‌ তবে কেউ কেউ ফিরেও আসেন বইকি ।‌ জমাট অন্ধকারের বিরুদ্ধে প্রাণপণ লড়াই করতে করতে একদিন হয়তো চ্যাম্পিয়নের গর্ব ঝলসে ওঠে । তখন আবার শুরু হয় নতুন যুদ্ধ । ফেরার লড়াই । অন্ধকারকে পরাস্ত করে আলোয় ফেরার যুদ্ধ ।

আশার কথা , সিমোন বাইলস আবার ফিরে এসেছেন আলোয় , স্বমহিমায় । মনের ভয়ঙ্কর অসুখ সেরে গেছে তাঁর । অলিম্পিকের মতো আসরে সাত-সাতটি পদক জয়ী আর্টিস্টিক জিমন্যাস্টিক্সের রানি সিমোন বাইলস টোকিও-র অন্ধকার অতিক্রম করে প্যারিসে একটি সোনা জিতেছেন ইতিমধ্যেই দলগত ইভেন্টে নিজের দেশকে নেতৃত্ব দিয়ে । অসাধারণ কৃতিত্ব ।

আর আমাদের দেশ ? আমাদের ভারতবর্ষ ? হ্যাঁ , এবার প্যারিসে আমাদের খবরও ভালো । ইতিমধ্যেই তিনটি পদক এসে গেছে । অবশ্য তিনটিই ব্রোঞ্জ পদক । মহিলাদের ১০ মিটার এয়ার পিস্তল শ্যুটিং প্রতিযোগিতায় ব্রোঞ্জ জিতে দেশকে গর্বিত করেছেন ২২ বছর বয়সী মনু ভাকের । এছাড়াও ১০ মিটার এয়ার পিস্তল শ্যুটিং প্রতিযোগিতায় মিক্সড টিম ইভেন্টে সরবজ্যোৎ সিং ও মনু ভাকের যৌথভাবে জিতেছেন আরও একটি ব্রোঞ্জ পদক । মনু ভাকের প্রথম ভারতীয় মহিলা শ্যুটার হিসেবে একই অলিম্পিকে দুটি পদক জয় করে ইতিহাস গড়েছেন । অসামান্য জয় , অবিস্মরণীয়।

তৃতীয় ব্রোঞ্জ পদকটি জিতেছেন স্বপ্নীল কুসালে ৫০ মিটার রাইফেল-৩ ইভেন্টে । হকিতে এবারও পদক পাওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে । ইতিমধ্যেই ভারতীয় হকি দল কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে গেছে । আরও বেশ কয়েকটি পদক আসার সম্ভাবনা রয়েছে বিভিন্ন ইভেন্টে । যদিও ১৪০ কোটির এই উপমহাদেশে হাতে গোনা কয়েকটি পদক জয় মোটেও মানানসই নয় । আরও অনেক উন্নতি দরকার ক্রীড়াক্ষেত্রে । আসলে ক্রিকেটে মজে আছে গোটা দেশ । অন্য খেলাগুলো যথেষ্ট অবহেলিত , এ কথা বলাই বাহুল্য । তবু বলতে হয় , একেবারে শূন্য হাতে অলিম্পিকের মতো আসর থেকে ফেরার চেয়ে কয়েকটি পদক জয় করে ফেরা অন্তত মন্দের ভালো । প্রবল শক্তিশালী ক্রিকেট দৈত্যের প্রতাপকে অগ্রাহ্য করে , সবার চোখের আড়ালে নীরবে নিভৃতে সাধনা করে আপাত উপেক্ষিত খেলাগুলোর হাত ধরে যাঁরা বিশ্বের সেরা আসরে পদক জয় করে দেশকে গর্বিত করছেন তাঁদের জন্য কোনো প্রশংসাই যথেষ্ট নয় । ভারতের খেলাধুলার ইতিহাসে এই সমস্ত পদকজয়ীদের নাম সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে ।

আরও পড়ুন- ইস্টবেঙ্গলকে আক্রমণ ইউটিউবারের, মুখ খুলল লাল-হলুদ ক্লাব