তৃতীয় মোদি সরকারের প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাজেট ছিল কার্যত তোষণের। যেখানে সরকার টিকিয়ে রাখতে অন্ধ্র, বিহারকে ঢেলে আর্থিক প্যাকেজ দিয়েছে মোদি সরকার, সেখানে বাংলার ভাগ্যে নিজেদের ন্যায্য প্রাপ্যটুকুও মেলেনি। যা নিয়ে বাজেট অধিবেশনের শুরু থেকেই সংসদের ভিতরে ও বাইরে সরব বাংলার শাসক দল তৃণমুল কংগ্রেস। কেন্দ্রীয় বাজেটে কোনও রাজ্যকে বঞ্চিত করা হয়নি বলে ১০০ মিনিটের জবাবি ভাষণে গতকাল, মঙ্গলবার সংসদে ফিরিস্তি দিয়েছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। নির্মলার সেই বক্তব্যের পাল্টা শ্বেতপত্র প্রকাশের দাবি জোরালো করল তৃণমূল। একইসঙ্গে বাংলার শাসকদল দাবি করল, ১০০ দিনের কাজ ও আবাস যোজনায় ২০২১ সালের পর থেকে কোনও টাকা দেওয়া হয়নি এ রাজ্যকে। একুশের বিধানসভা ভোটে হারের পর থেকে বাংলার মানুষকে ভাতে মারতে ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। বাংলার প্রতিহিংসামূলক ও বিমাতৃসুলভ আচরণ করছে কেন্দ্র।
আজ, বুধবার এই ইস্যুতে তৃণমূল ভবনে সাংবাদিক বৈঠক করেন রাজ্যের মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য এবং তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ। ১০০ দিনের কাজে ন্যায্য বকেয়া টাকা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই মোদি সরকারের বিরুদ্ধে সরব মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল। মুখ্যমন্ত্রী নিজে যা নিয়ে বারবার দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী মোদির কাছে দরবার করেছে, চিঠি দিয়েছেন, কিন্তু সুরাহা হয়নি। দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তথা সাংসদ অভিষেক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দিল্লিতে গিয়ে আন্দোলনও করেছেন, রাজভবনের সামনে ধর্না দিয়েছেন। কিন্তু এতকিছুর পরেও ন্যায্য পাওনা থেকে এখনও বঞ্চিত বাংলার খেটে খাওয়া মানুষ। এদিন সাংবাদিক বৈঠক থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য তুলে ধরেন কুণাল ও চন্দ্রিমা। যেখানে মোদি সরকার নিজেই জানাচ্ছে, ১০০ দিনের টাকা থেকে বঞ্চিত একমাত্র রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ।
গ্রামীণ এলাকায় কর্মসংস্থান তৈরি করতে কোন রাজ্যকে ১০০ দিনে কাজের কত টাকা দেওয়া হয়েছে, তার একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে কেন্দ্র। যেখানে ১০০ দিনের কাজের টাকা পাওয়ার রাজ্য হিসেবে উল্লেখ রয়েছে কেরল, মিজোরাম, তামিলনাড়ু, সিকিম, লাদাখ, পুদুচ্চেরী, হিমাচলপ্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশ, অরুণাচলপ্রদেশ, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা, তেলঙ্গানা, জম্মু ও কাশ্মীর, কর্নাটক, মেঘালয়, পঞ্জাব, ওড়িশা, রাজস্থান, ছত্তীসগঢ়, উত্তরাখণ্ড, অসম, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, ঝাড়খণ্ড, গুজরাত, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ এবং বিহারের। কিন্তু টাকা প্রাপকের তালিকায় নাম নেই পশ্চিমবঙ্গের। ওই রিপোর্টের নীচে লেখা রয়েছে, যে সমস্ত রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত এলাকাকে ২০২৪ অর্থবর্ষে টাকা দেওয়া হয়নি বা টাকার পরিমাণ নগণ্য, সেগুলির উল্লেখ নেই। মণিপুর, লাক্ষাদ্বীপ, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ, দমন দিউ ও দাদরা নগর হাভেলি এবং গোয়ার সঙ্গে সেখানে পশ্চিমবঙ্গের উল্লেখ রয়েছে। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গও টাকা পায়নি।
কেন্দ্রের রিপোর্টটিকে হাতিয়ার করেই কেন্দ্রের বিরুদ্ধে নতুন করে বঞ্চনার অভিযোগে সরব হলেন তৃণমূল নেতৃত্ব। এদিন কুণাল ঘোষ বলেন, “মোদি সরকারের রিপোর্টে ১০০ দিনের কাজে বাংলা প্রথম স্থানে রয়েছে। ভোটে হারের জন্য টাকাটা বন্ধ করল। দ্বিচারিতা করা হচ্ছে। তৃণমূল কখনও বৈষম্য করে না। বাংলায় হেরেছে বলে বাংলার মানুষকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। বাংলার বকেয়া কই, ১০০ দিনের টাকা কই? এটা তো মানুষ বলবে এবার।” তাঁর সংযোজন, “বাংলার মাটি থেকে কর নিয়ে যাচ্ছেন। তা হলে বাংলাকে তার প্রাপ্য দেবেন না কেন? বাংলা শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে বঞ্চিত।”
কুণালের সঙ্গে একই সুরে রাজ্যের মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বলেন, “বাংলার মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে, ১০০ দিনের কাজের টাকা দেওয়া হয় না। ২০২১ সালের পর থেকে কেন তথ্য দিয়ে বলতে পারলেন না। শ্বেতপত্র দিতে পারলেন না। ১০০ মিনিটের জবাবি ভাষণেও উল্লেখ করলেন না। তার মানে টাকা দেওয়া হয়নি। কেন মানুষকে তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হবে! আবাস যোজনার টাকা দেওয়া হয় না, বিভিন্ন খাতে যে টাকা প্রাপ্য, কিছুই দেয় না কেন্দ্র। ১ লক্ষ ৭১ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা পাওনা আমাদের। দিল্লির দরবারে হাজিরও হয়েছি আমরা। কিন্তু কী ব্যবহার করা হয় দেখেছেন। মুখ্যমন্ত্রী নিজেও শামিল হন। কিন্তু তার পরও টাকা আসেনি। ২০২১ সালের পর থেকে কোন খাতে, কত টাকা দিয়েছে কেন্দ্র, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় শ্বেতপত্র দাবি করেছেন। সংসদে দাঁড়িয়ে নির্মলা সীতারামন বলেছেন হাজার হাজার কোটি কোটি টাকা দিয়েছেন। তাহলে তো হিসেব থাকবে ওঁর কাছে! কোন বছর, কত টাকা দিয়েছেন, সেই হিসেব তাহলে পেতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়! কিন্তু শ্বেতপত্র দেওয়ার পথে হাঁটলেন না উনি। হাঁটতে পারবেনও না। কার টাকা দেওয়া হয়নি। বিজেপি আগামিদিনে বাংলায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।”
কেন্দ্রের রিপোর্ট নিয়ে চন্দ্রিমা আরও জানান, এই নথি রাজ্য সরকার প্রকাশ করেনি। কেন্দ্রীয় সরকারের রিপোর্ট, যাতে দেখা যাচ্ছে বাংলাকে টাকা দেওয়া হয়নি। ১০০ দিনের কাজের টাকা দেওয়ার ক্ষেত্রে সামঞ্জস্য নেই বলেও অভিযোগ তোলেন চন্দ্রিমা। তাঁর দাবি, গ্রামীণ মানুষের সংখ্যা কোথায় বেশি, সেই নিরিখে মজুরি বা বরাদ্দ নেই। বাংলাকে বাদ দিয়েছে কেন্দ্র। শ্বেতপত্রও দিতে পারছে না। কিন্তু কেন্দ্রের রিপোর্টেই স্পষ্ট যে বাংলাকে টাকা দেওয়া হয়নি। চন্দ্রিমা জানিয়েছেন, নীতি আয়োগের বৈঠকে বঞ্চনার কথা বলতে গেলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অপমান করে কেন্দ্র। কিন্তু জোর করে টাকা আটকে রেখেছে কেন্দ্র, বাংলার প্রাপ্য টাকা, ভাগের টাকা আটকে রাখা হয়েছে।
চন্দ্রিমা এদিন জানান, টাকা না দিয়েও মানুষকে বিভ্রান্ত করছে কেন্দ্র। কিন্তু সত্যকে চাপা দেওয়া যায় না। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর কথা মুখে বলা হলেও, বাংলাকে অন্যায় ভাবে বঞ্চিত করা হচ্ছে। কেন্দ্রের সরকার সংবিধানের কণ্ঠরোধ করছে, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে ধ্বংস করছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। তাঁর মতে, যে রাজনৈতিক দলই থাকুক না কেন রাজ্যে, মানুষ তো সকলের! তাহলে কেন বঞ্চিত করা হচ্ছে সাধারণ মানুষকে, প্রশ্ন তোলেন চন্দ্রিমা। একই সুর শোনা যায় কুণালের গলায়। তাঁর প্রশ্ন, বাংলা থেকে কর তুলে নিয়ে যাচ্ছে কেন্দ্র। সেখান থেকে বাংলার পাওয়না কেন মেটানো হবে না? বাংলার হকের টাকা রাজনৈতিক কারণে আটকে রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন তিনি।
আরও পড়ুন: অভিষেকের প্রশ্নের মুখে মোবাইল গ্রাহকদের অতিরিক্ত আর্থিক চাপের কথা মানল কেন্দ্র!