
দূর নয় বেশি দূর
ওই সাজানো সাজানো
বকুল বনের ধারে ,
ওই বাঁধানো ঘাটের পাড়ে ,
যেথা অবহেলা সয়ে সয়ে
কিছু ফুল শুকানো শুকানো হয়ে
পড়ে পড়ে আছে
তার কিছু দূরে
ঘাটের চাতাল ছাড়িয়ে
ওখানে আমার মাতাল হৃদয়
সেদিন গিয়েছে হারিয়ে ।
যাক যা গেছে তা যাক ।
প্রেমে পড়া , ঘর বাঁধার স্বপ্ন এবং শেষপর্যন্ত ব্যর্থ । এই তো চিরকালের চেনা গল্প । আর সফল হলে ?
সফল হলে গল্প নেই । গান নেই । কবিতা নেই । সাফল্য যেন অপরাধ । সাফল্যের পাশে সাহিত্য নেই । সফলতা যেন নেই রাজ্যের বাসিন্দা । মিলনে মরা প্রেম বিরহে বাঁচে।
‘ তারপর প্রেমিক ও প্রেমিকা সুখে-শান্তিতে সংসার করিতে লাগিল ‘ , এতে আর আশ্চর্যের কী আছে ! এ নিয়ে আর কী গান হবে ? এ নিয়ে লেখা কবিতা কোথায় পৌঁছোবে ? কে-ই বা পড়বে, শুনবে সেসব ?
‘ যার করতল নেই , সে কাকে ভিক্ষা দেবে ? ‘
তাই সাফল্য থাক । ব্যর্থতায় ফেরা যাক । হৃদয়ের বেদনার কথা গাইছেন এক ব্যর্থ প্রেমিক । স্থায়ী , অন্তরা ইত্যাদির পর্বান্তরে খানিক জিরিয়ে নিচ্ছেন তিনি । সেই ফাঁকে সান্ত্বনার নিভৃত নরম কথা সমস্বরে গাইছেন গানটির কোরাস দল । তাঁরা অসফল অতীত ভুলে গায়ককে সামনে তাকানোর পরামর্শ দিচ্ছেন । ভরসা দিচ্ছেন যেন । বোঝাতে চাইছেন , যা পাওয়া গেল না , তা নিয়ে হা-হুতাশ করে তো কোনো লাভ নেই । তাই , যা গেছে তা যাক ।
শুকসারীরা সেখানে
কূজনে কূজনে
দুজনে গাহিয়া যেতো ,
ওই নদীটি বহিয়া যেতো ।
বন হরিনী ত্বরিত
চকিত চরণে
চমক লাগায়ে দিয়ে
তার চেয়ে ভালো
চোখ দুটি দেখে
যেখানে যেত সে দাঁড়িয়ে ,
সেখানে আমার করুণ হৃদয়
সেদিন গিয়েছে হারিয়ে ।
যাক যা গেছে তা যাক ।
সাফল্য থাক । আপাতত ব্যর্থতায় ফেরা যাক । প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে , কে কোথা ধরা পড়ে কে জানে ।
‘ যা গেছে তা যাক ‘ , গানের ব্যর্থ নায়ক তাঁর যৌবনে পড়েছিলেন প্রেমের ফাঁদে । গ্রাম বাংলার বাঁধানো ঘাটের চাতাল , বকুল বন , ঝরে প’ড়ে থাকা শুকনো ফুলের স্তুপ , আর কলসি কাঁখে কাঙ্খিত প্রেয়সীর দর্শনে নায়কের মাতাল হৃদয় যেন চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছে সেখানেই ।
শুকসারী গান , বহতা নদী , বনহরিণীর চকিত চপল ছন্দ , আর হরিণের চেয়েও সুন্দর প্রিয়ার দীঘল চোখদুটি । এখানেই যে চুরি গেছে গায়কের হৃদয় ।
কিন্তু তারপর ?
এ বেদনার শেষ কোথায় ? কোথায় এই বিরহের অন্ত ? এই বিচ্ছেদ অন্তহীন । চির বিচ্ছেদ-জর্জর মজ্জা । যেদিন বধূবেশে সেজে অন্যের ঘর সামলাতে চিরদিনের মতো চলে গেল প্রেয়সী , বেদনার বৃত্ত সম্পূর্ণ হলো সেদিনই । ভাঙা মনে উথালপাথাল অনন্ত বেদনার গান ।
তাহলে কি কোনো সান্ত্বনাই আর অবশিষ্ট থাকলো না ? কে বলে ? কে বলে থাকলো না ? এত বড় পৃথিবীতে , এত দীর্ঘ জীবনে শুধু বিরহ দহন নিয়ে কীভাবে বাঁচবে মানুষ ? আছে । আছে সান্ত্বনা । আছে বিক্ষত হৃদয়ের আন্তরিক শুশ্রূষা । আছে , স্থান আছে , নইলে দাঁড়াবে কোথায় মানুষ ?
জীবনে এমন কিছু মর্মবিদারী ঘটনা বা দুর্ঘটনা প্রায় সবার জীবনেই ঘটে , যার পরে আর কিছুতেই যেন নিজেকে প্রাণিত বা উদ্বুদ্ধ করা যায় না। কিন্তু তারপরেও তো সূর্য ওঠে। পাখি ডাকে । ভোর হয়।
ফুল ফোটে । তরঙ্গ মিলায়ে যায় তরঙ্গ উঠে , কুসুম ঝরিয়া পড়ে কুসুম ফুটে ।
তাই , ‘ যা গেছে তা যাক ‘ , যেন একটা ‘ দর্শন ‘ হয়ে জেগে থাকে জীবনের দীর্ঘদূর যাত্রাপথে । এ শুধুমাত্র একটা কথার কথা নয় । কী পাওয়া গেল না , কী পেলে কী হতে পারতো , এ সবের হিসেবনিকেশ করা মানে তো অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়া । তার চেয়ে যা পাওয়া গেল তা নিয়ে ভাবাই কি শ্রেয় নয় ?
নৈরাশ্যের বন্দনাগান কি বেঁচে থাকার একমাত্র উদ্দেশ্য হতে পারে ? তাই , ‘ যা গেছে তা যাক ‘ , একটা একটা মন্ত্রের মতো বাজতে থাকুক সারা বিশ্বের সমস্ত দুঃখী ও বিরহীদের হৃদয়ের নিভৃত তন্ত্রীতে । অতীতের মোহ ছিন্ন করে , সমস্ত বিচ্ছেদ-বেদনার নিঃসীম আঁধার পেরিয়ে জগতের যত কপালমন্দ মানুষ এগিয়ে যাক জীবনের খোঁজে নতুন উদ্যমে । গাইতে থাকুক , সারাদিন সারাক্ষণ গাইতে থাকুক , ‘ যা গেছে তা যাক ‘।
আরও পড়ুন- জয়ে ফিরল ইস্টবেঙ্গল , লিগ টেবিলের লাস্টবয় হায়দরাবাদ এফসিকে হারাল ১-০ গোলে