
মেলার মধ্যে মাইকে একজন হাঁকছে, ‘ হরনাথ , তুমি যেখানেই থাকো , আমাদের অনুসন্ধান অফিসের সামনে চলে এসো , তোমার মা তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন । ‘
এটি একটি কবিতার সূচনা- অংশ । কবিতাটি শেষ হচ্ছে এইভাবে , ‘ হরনাথ , তুই কি আর বাড়ি ফিরবি না’
আমরা কোনদিনও জানতে পারি না হরনাথের শেষ পর্যন্ত কী হলো । সে কি বাড়ি ফিরলো , নাকি চিরদিনের জন্য নিরুদ্দেশ হয়ে গেলো ! সাবালকেরা নিখোঁজ হলে তার কারণ হিসেবে হতাশা , সংসারবৈরাগ্য , দারিদ্র্য , বিপথগমণ ইত্যাদি বহুবিধ কথা উঠে আসে । কিন্তু নাবালক শিশু ও কিশোরদের ক্ষেত্রে ? পথ ভুলে নিজের ঠিকানায় না ফিরে অন্য কোথাও চলে যায় আর ক’জন ? তাহলে ? কী হয় তাদের শেষপর্যন্ত ?
‘ নীল , তুমি যেখানেই থাকো ফিরে এসো । তোমার মা ভীষণ অসুস্থ । ‘
এমন বিজ্ঞপ্তি তো কতই দেখা যায় রোজকার খবরের কাগজে । আবার এমন বিজ্ঞপ্তিও থাকে , ‘ বিধু মজুমদার , উচ্চতা ৫ ফুট ৩ ইঞ্চি , বয়স ৪৩ , কপালের ডানপাশে ছোট্ট কালো দাগ , সবুজ হাফহাতা জামা , কালো প্যান্ট , বাড়ি দরিয়ানগর , পূর্ব বর্ধমান , গত ৭ এপ্রিল থেকে নিখোঁজ । উক্ত ব্যক্তির সন্ধান পেলে অনুগ্রহ করে লালবাজার মিসিং স্কোয়াডের নিম্নলিখিত ঠিকানায় জানান অথবা এই নম্বরে ফোন করুন। ‘
এরা যায় কোথায় ? কেনই বা যায় ? সবাই কি স্বেচ্ছায় ঘরবাড়ি , আত্মীয় স্বজনদের ছেড়ে চলে যায় ? তথ্য অনুযায়ী জানা যায় এদের একটা বড় অংশ ফিরে আসে না । কেন ফিরে আসে না ? মনে মনে হারিয়ে যাওয়ার মানা হয়তো নেই । কিন্তু সশরীরে কারো হারিয়ে যাওয়া , সাবালক অথবা নাবালক , নারী অথবা পুরুষ , বয়স্ক কিংবা অল্পবয়সী , দারুণ এক আলোড়ন তোলে পরিচিতদের মনে । শুরু হয় খোঁজাখুঁজি , থানাপুলিশ । নিরুদ্দেশ বিজ্ঞপ্তিও ছাপা হয় খবরের কাগজে । কাছাকাছি কুয়োয় , পুকুরে , নদীতে , কাছে ও দূরের রেললাইনে , হাসপাতালে ও মর্গে কিছুদিন টানা চলতে থাকে খোঁজাখুঁজি। তারপর সময় গড়ানোর সাথে সাথে আলোড়ন ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে আসে । সকলেই যে যার কাজে ডুবে যায় । শুধু যে বাড়ির মানুষটি হারিয়ে গেল , সেই পরিবারে এই হঠাৎ হারিয়ে যাওয়াটি বড়ো বেদনার মতো , নিঃশব্দ হাহাকারের মতো নিশিদিন জেগে থাকে । আমাদের মনে পড়ে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাসের হাহুতাশ : কোথায় চলে গেলি রে বিলু !
এই বিলুর চলাফেরা ছিল হুইলচেয়ারে । বিলু আর ফেরে নি । কিন্তু কেউ কেউ ফিরেও আসে অবশ্য । খুঁজে পাওয়া যায় কয়েকজনকে । অনেকেই ফেরে না । এই যে সকলের মাঝে সকলের সঙ্গে থাকতে থাকতে হঠাৎই একদিন ভোজবাজির মতো একজনের উধাও অথবা গুম হয়ে যাওয়া , এ বিস্ময়ের ঘোর সহজে কাটে না । কেউ নিখোঁজ হয় একেবারে নিঃশব্দে , কাউকে বিন্দুমাত্র কিছু জানতে না দিয়ে । আবার কেউ নিখোঁজ হয় চিঠি বা চিরকুট লিখে । আবার এর মধ্যে বেমালুম চুরি হয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটে । কিডন্যাপিং নয় , জলজ্যান্ত একটা মানুষকে স্রেফ চুরি করে নিয়ে গেল কতিপয় দুস্কৃতী , অবশ্যই অসদুদ্দেশ্যে , এও তো মাঝেমাঝেই ঘটে । এইসব ঘটনার কোনো হিল্লে হয় না সহজে ।
বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশগুলোর অন্যতম ভারতবর্ষ । ভারতে নিখোঁজ ব্যক্তিদের সংখ্যা উদ্বেগজনক। পরিসংখ্যান দেখায় যে , ভারতে প্রতি ঘণ্টায় ৪৪ জন মহিলা , পুরুষ ও শিশু নিখোঁজ হয় , প্রতিদিন ২১৩০ জন এবং প্রতি মাসে ৬৪৮৫১ জন মানুষ নিখোঁজ হয় । বিশ্বের সামগ্রিক জনসংখ্যার প্রায় ১৮ শতাংশ মানুষ ভারতের অধিবাসী ।
মিশরের একটি মানবাধিকার সংগঠনের বয়ান অনুযায়ী , সেদেশে গত চার বছরে কমপক্ষে ১ হাজার ৫০০ জন নিখোঁজ হয়েছে । হয়তো আসল সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি । এদেশে ‘ রহস্যময় অন্তর্ধান ‘ বিগত কয়েক বছরে বেশ বেড়েছে ।
পেরুতে নিখোঁজ ব্যক্তিদের মধ্যে ২০২৩ সালের প্রথম চার মাসে ৩৪০৬ জন নারী নিখোঁজ হওয়ার অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে । এর মধ্যে ১৯০২ জনকে খুঁজে পাওয়া গেছে । সামাজিক , অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ব্যর্থতা তো রয়েছেই , তার সঙ্গে এই ভয়ঙ্কর অস্থির সময়ের নৃশংস অমানবিকতা ও বিচ্ছিন্নতাবোধ সারা বিশ্বের নানা দেশে নিখোঁজ মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য দায়ী । আমেরিকায় প্রতি বছর লক্ষ মানুষ নিখোঁজ হয় । জাপানেও নিখোঁজ ব্যক্তিদের সংখ্যা বিপুল । যুক্তরাজ্যেও বিরাট- সংখ্যক মানুষ নিখোঁজ হয় প্রতি বছর ।
ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অন মিসিং পার্সনস ( আই সি এম পি ) অনুসারে , বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ২০০০০০ মানুষ নিখোঁজ রয়েছে বলে অনুমান করা হয় । এই সংখ্যা বেশিও হতে পারে , কারণ অনেক ক্ষেত্রেই রিপোর্ট করা বা নথিভুক্ত করা হয় না ।
কলম্বিয়া ও মেক্সিকোয় প্রচুর মানুষ নিখোঁজ হয় প্রতি বছর। অন্যদিকে , সিরিয়া , নাইজেরিয়া প্রভৃতি দেশে নিখোঁজ মানুষের সংখ্যা যথেষ্ট উদ্বেগজনক । সারা পৃথিবী জুড়েই মানুষের হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার ঘটনাও বিরামহীনভাবে চলতেই থাকে । স্বেচ্ছায় অন্তর্ধান নানা কারণে ঘটতে পারে । মানসিক বৈকল্য , বৈরাগ্য , অশান্তি , পারিবারিক বিবাদ , ভয়াবহ সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাপ , সাংস্কৃতিক দূষণ , চারপাশের জটিল কুটিল নেতিবাচক প্রভাব এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশ মানুষকে স্বস্থান ছেড়ে চলে যেতে প্ররোচিত করতে থাকে প্রতিনিয়ত । এ এক গভীর অসুখ পৃথিবীর ।
পরিশেষে , পশ্চিম বর্ধমানের কোনো এক শহরের একটি ঘটনা । বিগত দিনের কোনো একটি নির্বাচনের ঠিক তিন দিন আগে একটি বাড়িতে বুথ স্লিপ দিতে এসেছেন একটি রাজনৈতিক দলের কয়েকজন কর্মী । বাড়িতে কড়া নাড়তেই বেরিয়ে এলেন সে বাড়ির প্রৌঢ় গৃহকর্তা । বাড়ির পাঁচজন সদস্যের জন্য পাঁচটি স্লিপ তাঁকে দেওয়া হলো । কিন্তু তিনি একটি স্লিপ কর্মীদের হাতে ফিরিয়ে দিলেন । কর্মীরা অবাক হয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই প্রৌঢ় বললেন , ‘ পলি তো ভোট দেবে না ‘ । ভোট না দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে উনি বললেন , ‘ পলি হারিয়ে গেছে, আমরা অনেক খোঁজাখুঁজি করেও ওকে খুঁজে পাইনি কোথাও ।থানাপুলিশ , নিরুদ্দেশ বিজ্ঞপ্তি , কিছুই বাকি রাখি নি । কোথায় যে চলে গেলো আমাদের মেয়েটা ‘ !
আরও পড়ুন- তৃতীয় বিয়ে ‘অবৈধ’! ৭ বছরের সাজা ইমরান-বুশরা বিবির