
‘ যে সবাইকে খারাপ ভাবে সে সবার চেয়ে খারাপ । ‘সত্যিই কি তাই ? সবাইকে খারাপ ভাবার মৌলিক অধিকার তো সবারই আছে । সবাইকে ভালো ভাবার স্বাধীনতাও সকলেরই আছে । অতএব অন্যদের খারাপ ভাবলেই নিজেরও খারাপ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তেমন আছে কি ? ঠিক তেমনি এর উল্টোদিকটাও ভাবতে হবে । যে সবাইকে খারাপ ভাবছে , সে আসলে সবার খারাপ দিকটাই দেখতে পাচ্ছে , ভালো দিকগুলো দেখতে পাচ্ছে না । তার মানে , তার নজর খারাপ দিকেই । কথায় আছে , শকুন যত উঁচুতেই উড়ুক না কেন তার নজর ভাগাড়ের দিকে । অতএব , যে মানুষের ভালো দিকগুলো দেখার ক্ষমতা যে হারিয়ে ফেলেছে , খারাপ দিকগুলো ছাড়া আর কিছু যে দেখতে পায় না , সে নিজেও অবশ্যই খারাপ অথবা নেতিবাচক ভাবনায় পরিচালিত মানুষ সবকিছুর মধ্যেই খারাপ দেখে। তার মানে কিন্তু এই নয় যে , নেতিবাচক চিন্তায় প্রভাবিত মানুষের ভালো হওয়ার সম্ভাবনা একেবারে শূন্য ।
কথায় কথা বাড়ে । আবার , রাম খটাখট ঘ্যাচাং ঘ্যাচ , কথায় কাটে কথার প্যাঁচ । অনেকেই বলেন , প্যাঁচহীন কথা আলুনি ব্যঞ্জনের মতো ।কথার প্যাঁচ তথা কথার জট খুলতে না পারলে ভাবনার জানলা খোলে না । যে নিজে সবসময় মিথ্যা বলে , সে সবাইকে ভাবে মিথ্যাবাদী । যে নিজে অপরাধপ্রবণ , সে সবাইকে ভাবে অপরাধী । চোখ কান একটু খোলা রাখলেই এসব বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় । এর জন্য মনোবিজ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না ।
কেউ যদি বলে , ‘ জগতে কেউ ভালো নয় ‘ , তাহলে সে নিজেও ভালো নয় ধরে নিতেই হয় , কেন না, সে নিজেও তো জগতের বাইরে নয় । কিন্তু , ‘ জগতে কেউ ভালো নয় ‘ , কথাটির সঙ্গে যদি সে এই কথাটি যোগ করে দেয় যে , ‘ এটি একটি মিথ্যা ‘ , তাহলে কী দাঁড়ায় ? এভাবেই ক্রমশ জটিল হতে থাকে জাল , কথার জাল ।
প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক এপিমেনাইডেস- এর একটি বিখ্যাত উক্তি এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় । তিনি ছিলেন ক্রিটের নাগরিক । তাঁর বিখ্যাত ঘোষণা ছিল ,’ ক্রিটের সকল নাগরিক মিথ্যাবাদী ‘ । এক্ষেত্রে কথাটা যদি সত্য বলে ধরে নেওয়া হয় , তাহলে তিনি নিজেও মিথ্যাবাদী , কারণ তিনি নিজেও ক্রিটের নাগরিক । আবার তাঁর কথাটা যদি মিথ্যা হয় , তাহলে ক্রিটের নাগরিকেরাও মিথ্যাবাদী নয় । এ থেকে স্থির কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছোনো সম্ভব কি ?
এবার অন্য একটি উদাহরণ । যে শব্দগুলো নিজেদের ব্যাখ্যা করতে পারে তাদের autological শব্দ বলে । যেমন noun নিজেও একটি noun । আবার যে শব্দগুলো নিজেদের ব্যাখ্যা করতে পারে না তাদের heterological শব্দ বলা হয় । যেমন verb নিজে কিন্তু verb নয় , একটি noun । এখন প্রশ্ন হলো ,
heterological শব্দটি কি নিজে heterological ? এর উত্তর যদি ‘ হ্যাঁ ‘ হয় , তাহলে ধরে নিতে হয় heterological শব্দটি নিজে heterological , কিন্তু তাই যদি হয় , তাহলে তো শব্দটি নিজেকে বা নিজেদের ব্যাখ্যা করতে পারছে । কিন্তু আমরা তো জানি, যে শব্দগুলো নিজেদের ব্যাখ্যা করতে পারে তারা autological ! আবার এর উত্তর যদি , ‘ না ‘ হয় , তার মানে heterological শব্দটি নিজে heterological নয় , autological । আর autological হলে সে নিজেকে ব্যাখ্যা করতে পারবে , যা কিনা heterological- এর সংজ্ঞার বিপরীত।
আরও পড়ুন- পশ্চিমবঙ্গের প্রথম ওমেন প্লেগ্রাউন্ড গেমিং স্টোর চালু হল
এবার আরেকটি কথার প্যাঁচ দেখা যাক । একটা কার্ডের দু’পাশে দুটি বাক্য লেখা আছে । একপাশে লেখা আছে যে , ‘ অপর পাশের লেখাটি সত্য ‘ । আবার অপর পাশে লেখা আছে যে , ‘ অপর পাশের লেখাটি মিথ্যা ‘ । এবার ভেবে যেতে হবে , অনন্তকাল ধরে ভেবে যেতে হবে যে উল্লেখ্য দুটি বাক্যের মধ্যে কোনটি সত্য ।
কথার জটিল জাল পাতা রয়েছে সর্বত্র । এক শহরে একটা রেস্টুরেন্ট আছে । সেই রেস্টুরেন্টে এত ভিড় হয় যে , কেউ সেখানে যায় না । এখন প্রশ্ন হলো , কেউ যদি না যায় , তাহলে সেখানে এত ভিড় হয় কীভাবে ?
সক্রেটিসের বিখ্যাত উক্তি : আমি কিছুই জানি না । এখানে তাঁর কথা যদি সত্য বলে ধরে নেওয়া হয় , তাহলে তিনি সত্যিই কিছু জানেন না । কিন্তু তাহলে তো তাঁর জানাটা সত্য প্রমাণিত হলো , যা কিনা না জানার মধ্যে পড়ে । আবার তাঁর কথাটা যদি মিথ্যা বলে ধরা হয় , তাহলে তার অর্থ দাঁড়ায় , ‘ তিনি অনেক জানেন , যা কিনা তাঁর উক্তির সঙ্গে সঙ্গতিসূচক নয় ।
আসলে এ সবই প্যারাডক্স , অর্থাৎ কূটাভাস । প্যারাডক্স হলো এমন কিছু বাক্য বা উক্তি , যা থেকে নির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্তে আসা যায় না । এইসব বাক্যের অর্থ বের করতে গেলে সাধারণত দুটি পরস্পরবিরোধী সমাধান পাওয়া যায় , যার কোনোটিকে সম্পূর্ণ সত্য বা সম্পূর্ণ মিথ্যা বলা যায় না।
এমন দুটি সমাধানের একটি সত্য হলে অপরটি মিথ্যা হয় , আবার অপরটি সত্য হলে অন্যটি মিথ্যা হয় । এই সমস্ত বিভ্রান্তিকর গাণিতিক ও দার্শনিক বাক্য চিন্তার চর্চা ও অনুশীলনের ক্ষেত্রে দারুণ জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । চিন্তার জড়তা থেকে মুক্তি দেয় মানুষকে । নতুন ভাবনাচিন্তার দরজা খুলে দেয় । তাই চিন্তাশীল মানুষেরা প্যারাডক্স পছন্দ করেন । সাধারণ মানুষের কাছেও প্যারাডক্সের যথেষ্ট কদর আছে । Paradox ইংরেজি শব্দ হলেও মূল শব্দটি এসেছে একটি গ্রিক শব্দ থেকে । এর উৎপত্তিস্থল প্রাচীন গ্রীস ।
যদি কেউ বলে , ‘ হায় , একদিন সব শেষ হয়ে যাবে ‘ , তাহলে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ার কোনো দরকার নেই । কারণ , শেষ না হলে শুরু হবে কীভাবে ? তার মানে, একদিন সব কিছুর শুরু হবে একেবারে শূন্য থেকে।