শুক্রবার দিনভর অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মামলার বিষয় নিয়ে ভুল ব্যাখ্যা সংবাদ মাধ্যমে। যদিও ‘এখন বিশ্ব বাংলা সংবাদ’ বারবার বলেছে অভিষেকের পক্ষে গিয়েছে আদালতের মত। সেটাই প্রমাণিত হল সুপ্রিম কোর্টের অর্ডার বেরোনোর পর। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মামলায় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনামা লিখিত আকারে আপলোড হতেই স্পষ্ট হয়ে গেল আসলে এই মামলায় ঠিক কী বলতে চেয়েছে শীর্ষ আদালত। এখন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ও তৃণমূলকে কালিমালিপ্ত করতেই শীর্ষ আদালতের রায়ের ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কুৎসাকারীরা শীর্ষ আদালতের স্পষ্টভাবে বলে দেওয়া আইনি ব্যাখ্যাকে নিজেদের রাজনৈতিক ব্যাখ্যায় পরিণত করে অভিষেক ও তৃণমূলের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের নেমেছে বিরোধীরা। অর্ডারে স্পষ্ট বলা হচ্ছে, এটা দুর্ভাগ্যজনক যে এই রিপোর্টিং বা মন্তব্য ব্যক্তি কেন্দ্রিক। গতকাল অর্থাৎ সেখানে দেওয়া আদেশটি বিশ্লেষণ করে উদ্ধৃত করা হচ্ছে। শীর্ষ আদালতে রায়ের অর্ডারে স্পষ্ট বলা হচ্ছে, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে রাজনৈতিক ভাবে টেনে আনা হচ্ছে।
কুৎসাকারীদের পক্ষ নিয়ে এক শ্রেণির সংবাদ মাধ্যমও প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে শীর্ষ আদালতে ধাক্কা খেয়েছেন অভিষেক। হেডলাইন তো হল কিন্তু আসল আইনি ব্যাখ্যা কোথায়? এখন যে অর্ডার আপলোড হয়েছে তাতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সুপ্রিম কোর্ট বলছে, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের তরফে যে আবেদন করা হয়েছিল সেই সংক্রান্ত বিষয় আগেই কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে চ্যালেঞ্জ হয়েছিল। ২০২৩-এর ৫ অক্টোবর ডিভিশন বেঞ্চ যে রায় দিয়েছিল, ২০২৩-এর ৮ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্ট তাতেই সিলমোহর দেয়। ৫ অক্টোবরের রায়ে ডিভিশন বেঞ্চ ঠিক কী বলেছিল? সেখানে স্পষ্ট বলা হয়েছিল, কোনও একটি তদন্ত যখন একজন সিঙ্গল বিচারপতি মনিটর করছেন তখন তিনি এমন কোনও অবাঞ্ছিত মন্তব্য করবেন না যা ওই তদন্তকে প্রভাবিত করে। এবং যার বিরুদ্ধে এই তদন্ত চলছে বা যাকে সামন করা হয়েছে তার সাংবিধানিক অধিকার খর্ব হয়। সঙ্গে এও বলা হয়, আদালতের প্রচেষ্টা থাকবে তদন্ত হবে নিরপেক্ষ এবং দ্রুত। সর্বপরি একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তদন্ত শেষ করে তদন্তকারী সংস্থাকে আদালতে সেই রিপোর্ট জমা দিতে হবে। তদন্তকারী সংস্থা ঠিকমতো তথ্য জোগাড় করবে, তা বিশ্লেষণ করবে তারপর ফাইনাল রিপোর্ট আদালতকে দেবে। বিচারের বাইরে গিয়ে এইসব মন্তব্য বিচারপতিদের মুখে আদৌ শোভা পায় কি না, প্রশ্ন উঠেছে। বিষয়গুলি মাথায় রেখেই অভিষেক মামলায় নির্দেশ দিতে গিয়ে বিচারপতি বলেন, বিচারপতিরা মামলা নিয়ে বিভ্রান্তিকর বা বিচ্ছিন্ন মন্তব্য করতে পারবেন না।
বিচারপতি সঞ্জীব খান্না এবং বিচারপতি এসভিএন ভাট্টির নির্দেশ অনুসারে ডিভিশন বেঞ্চের পর্যবেক্ষণ, নিম্ন ডিভিশনের নির্দেশ নিশ্চিত করেছে। ৬টি মামলার রায়ের কথা উল্লেখ করছেন। সেগুলি হল-
১. পি চিদম্বরম বনাম ডাইরেক্টরেট অফ এনফোর্সমেন্ট (২০১৯) ৯ এসসিসি ২৪
২. স্টেট অফ ওড়িশা বনাম উজ্জ্বলকুমার বর্ধন (২০১২) ৪ এসসিসি ৫৪৭
৩. ডাইরেক্টর, সিবিআই বমান নিয়ামা ভেদি (১৯৯৫) ৩ এসসিসি ৬০১
৪. ভেঙ্কট সুব্রমণ্যম বমান এমকে মোহন কৃষ্ণমাচারি (২০০৯) ১০ এসসিসি ৪৮৮
৫. ভারত সরকার বনাম প্রকাশ পি হিন্দুজা (২০০৩) ৬ এসসিসি ১৯৫
৬. নীহারিকা ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রা.লি. বনাম মহারাষ্ট্র সরকার এবং অন্যান্য, এআইআর ২০২১ এসসি ১৯১৮,
২০২১ এসসিসি অনলাইন এসসি ৩১৫ এরপরে সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্টভাবে বলছে, আমরা জানাতে চাই আদালত যখন কোনও নির্দেশনামা দেবে তখন তা ভাসা ভাসা হবে না। তা সুনির্দিষ্ট নির্দেশ হতে হবে। সেই নির্দেশ অবশ্যভাবে তদন্তকারী সংস্থা-সহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে মানতে হবে। এই অর্ডার যদি কারও পছন্দ না হয় বা কেউ যদি মনে করেন তার প্রতি বা সংস্থার প্রতি যথাযথ বিচার হয়নি তবে সেই ব্যক্তি বা সংস্থা ওই অর্ডার চ্যালেঞ্জ করতে পারেন। এখানেই আসল বিষয়টি লুকিয়ে আছে। সেটি কী? সুপ্রিম কোর্ট বলছে, বর্তমান আবেদনের ভিত্তিতে অর্থাৎ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় যে আবেদন করেছেন তার ভিত্তিতে নতুন কোনও নির্দেশ আমরা দিচ্ছি না। অভিষেকের কোনও বক্তব্য থাকলে বা তিনি এবিষয়ে আরও কিছু বলতে চাইলে, পছন্দ না হলে তিনি সরাসরি কলকাতা হাইকোর্টের বেঞ্চে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন পুনরায় আমাদের কাছে আসার আগে।
সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি সঞ্জীব খান্না ও বিচারপতি এস ভি এন ভাট্টির বেঞ্চে অভিষেকের আইনজীবী গোপালকৃষ্ণণ আইয়ার বলেন, কলকাতা হাই কোর্টের এক মহিলা বিচারপতি এমন কিছু পর্যবেক্ষণ রাখছেন, যা ইডি-র সরকারি আইনজীবীও বলছেন না। দুর্নীতি, বিশাল সম্পত্তির মতো কথা উঠে আসছে তাঁর পর্যবেক্ষণে। যেগুলি হাতিয়ার করে বিরোধী নেতারা টুইট করছেন। চলছে ‘মিডিয়া ট্রায়াল’। এই সময় তিনি ‘সাহারা বনাম সেবি’ মামলার উল্লেখ করে আদালতে অনুরোধ করেন, যেন মিডিয়ার প্রচার বন্ধের নির্দেশ দেয় আদালত।
সুপ্রিম কোর্টের নোটিশ অনুযায়ী, শুধুমাত্র বাস্তব এবং উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা উচিত। মামলায় নজরদারি করার নামে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে বিচারপতিরা হস্তক্ষেপ করছেন। বিশেষত কলকাতা হাইকোর্টের কিছু মামলায় বিচারপতিদের মন্তব্য আইনি মহলে রীতিমহলে সমালোচিত হয়েছে। বিচারের বাইরে গিয়ে এইসব মন্তব্য বিচারপতিদের করা আদৌ শোভা পায় কি না সে প্রশ্নও উঠেছে। সেই বিষয়গুলিকে মাথায় রেখে শুক্রবার সুপ্রিম কোর্টে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মামলায় বিচারপতিদের মামলা নিয়ে মন্তব্য বা হস্তক্ষেপের উপর গণ্ডী টানে বিচারপতি সঞ্জীব খান্নার বেঞ্চ।
আসলে আপলোড করা এই অর্ডার প্রমাণ করে দিল বিরোধী কুৎসাকারীরা কতখানি ঘৃণ্য রাজনীতি করছে। এবার কী বলবে তারা?
সুপ্রিম কোর্টের রায় প্রকাশ হওয়ার পরেই তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষও (Kunal Ghosh) তাঁর পোস্টে লেখেন, ‘‘অভিষেক মামলায় সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, ১) বিচারপতিরা মামলা নিয়ে বিভ্রান্তিকর বিচ্ছিন্ন মন্তব্য করতে পারবেন না। ২) নজরদারির নামে তদন্তে হস্তক্ষেপ করা যাবে না। ইডি নিয়মমতো কাজ করবে। ৩) মামলা সংক্রান্ত ভুল, বিভ্রান্তিকর রিপোর্টিং করা যাবে না।’
আরও পড়ুন- NDTV-র পর এবার IANS, আরও একটি সংবাদসংস্থার সিংহভাগ শেয়ার কিনে নিল আদানি গোষ্ঠী