‘ধরায় অধরা ডন’, উৎপল সিনহার কলম

0
1
উৎপল সিনহা

অসম্ভব ! জাস্ট ইম্পসিবল !
তোমার যত ক্ষমতাই থাক না কেন , তুমি ডনকে ছুঁতে পারবে না । তোমার হাতে পুলিশ মিলিটারি , তোমার হাতে হাজার অস্ত্র , কিন্তু ডন সে সব পাত্তা দেয় না । ডন একা , নিরস্ত্র , নিঃসঙ্গ । তার ক্ষমতা তার মগজ । তার মন , তার হৃদয় । সেখানে কারফিউ জারি করার সাধ্য নেই রাষ্ট্রের। তার ক্ষমতা তার চিন্তা , তার চেতনা , তার স্বপ্ন । তার স্বপ্নগুলোর পায়ে বেড়ি পরানোর কৌশল জানে না রাষ্ট্র । তার উদ্ভট কাজকর্মগুলো রুখে দেওয়ার পদ্ধতি জানা নেই রাষ্ট্রের । ডনের আশ্চর্য সুক্ষ্মতার ধারেকাছে পৌঁছোতে পারে না মাথামোটা রাষ্ট্র । ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে ডনের দিকে , দেখতে থাকে তার বাউণ্ডুলে সব কাণ্ডকারখানা । তাকে শাসন করবে কে ? তাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়বে কে ? ডনকে মানুষ ভালোবাসে ।

কে এই ডন ? ‘ ডন ‘ তো ইংরেজি উচ্চারণে । আসলে তো ‘ দন ‘ । স্প্যানিশ উচ্চারণ ‘ দন কিহোতে ‘ ।
আজ থেকে ৪০০ বছর আগে লেখা এক স্প্যানিশ আখ্যানের নায়ক ডন । স্পেনীয় লেখক মিগুয়েল দ্য সেরভান্তেস ( ১৫৪৭-১৬১৬ ) লিখেছিলেন ‘ ডন কুইক্সোট ‘। এটি একটি অমর সাহিত্যকর্ম। একটি মহাকাব্যিক উপন্যাস ।

স্প্যানিশ তথা বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম সেরা রচনা । ১৬০৫ ও ১৬১৫ সালে দুটি খণ্ডে এটি প্রকাশিত হয় । মূল শিরোনাম : এল ইনজেনিওসো হিদাল গো ডন কুইক্সোট ডেলা মাঞ্চা । পৃথিবীর যে কোনো সমস্যার হাতে গরম মুশকিল আসান এই ‘ ডন কিহোতে ‘ । আর কোনো কাল্পনিক চরিত্র বিশ্বে এত জনপ্রিয়তা পেয়েছে কি?

মনে হয় না । দস্তয়েভস্কি , আলব্যের কামু , পিকাসো , দালি , কাফকা , বোর্হেস থেকে আমাদের সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পর্যন্ত সকলেই মুগ্ধ ও বিস্মিত হয়েছেন ডনের কার্যকলাপে । ডন কিহোতে বোধহয় সেই কান্তিময় আলো , পৃথিবীতে অদ্ভুত আঁধার নেমে এলে যার খোঁজে হন্যে হয় মানুষ ।

আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক নিরাপদ ভাবনাগুলোর ঝুঁটি ধরে নাড়া দেয় ডন । সে হাওয়া-কলের বিরুদ্ধে লড়ে !
সে কি পাগল ? সরাইখানাকে সে ভাবে শত্রুর দুর্গ ! সে কি স্বাভাবিক ? তবুও চারশো বছর ধরে মানুষ ডনের নামে অজ্ঞান ! মানুষ কি পাগল ? নাহলে ডনের গোঁয়ার্তুমিকে এভাবে সমর্থন করা যায় ? ডন কখন যে কী ঘটিয়ে দেয় কিচ্ছু বলা যায় না ! সে একজন দিব্যোন্মাদ নাইট ।

একইসঙ্গে কমিক ও ট্র্যাজিক চরিত্র । তাকে মূল্যায়ন করতে গেলে কোনো হিসেবই মেলে না । সে নিজেও কেমন যেন গোলমেলে । সে বেশ্যাদের মনে করে রাজকুমারী , মেষপালকদের মনে করে শত্রুসেনা , ধনী ও ক্ষমতাশালীদের মনে করে দুর্বৃত্ত ।

উপন্যাসের ডন মোটামুটি অভিজাত পরিবারের সদস্য । সে ফ্যান্টাসি ও রোমান্টিক গল্প পড়তে ভালোবাসে । নিজেকে নাইট কল্পনা করে । বাস্তবের সঙ্গে সংঘাত বাধানোই যেন তার একমাত্র কাজ । কায়েমী স্বার্থান্বেষীদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত প্রচণ্ড শক্তিশালী একটা রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটি মানুষ একাই লড়ে যাচ্ছে প্রাণপনে , এ বড়ো সহজ কাজ নয় । তার লড়াইয়ের যা ধরণ , যে ভঙ্গি , তার যা বিরুদ্ধাচরণ , সেগুলো যেন আমাদের অপরিচিত । অথচ ডন যা করে , সেগুলো যে প্রতিবাদ , তা বেশ বোঝা যায় । কিন্তু তার কল্পনাপ্রবণতা , তার রঙ্গ , তার উদ্ভট সব কাজ কারবার , তার বিদ্রোহের ধরণ ও ভঙ্গি আমাদের কাছে ভীষণ রকম অভিনব । ডন চায় রাষ্ট্রব্যবস্থার বদল , চায় আমূল পরিবর্তন । সে তো অনেক মানুষই চায় , কিন্তু রাষ্ট্রের নৃশংসতার বিরুদ্ধে লড়ার সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারে না । নানা অভিনব উপায়ে সকলের লড়াইটা একাই করে চলে ডন । এখানেই ডন বিশেষ , এখানেই সে স্বতন্ত্র । আর এখানেই তার একক লড়াইয়ের সার্থকতা । ডনকে তাই ভালো লাগে আমাদের । আমাদের এই সমবেত স্বার্থসর্বস্ব কাপুরুষোচিত বেঁচে থাকাকে প্রতিমুহূর্তে লজ্জা দিয়ে যায় ডন কিহোতে ।

সকলেই তো ডন হতে চায় , কিন্তু পারে ক’জন ? ডন সেই বিরল পুরুষ , যাকে স্বপ্ন দেখা যায় , কল্পনায় লালন করা যায় , কিন্তু ধরা বা ছোঁয়া যায় না । বলিউডের হিন্দি সিনেমার সংলাপ বঙ্গানুবাদ করে বলা যেতেই পারে , ডনকে ধরা শুধু যে মুশকিল তাই নয় , ডনকে ধরা অসম্ভব । কারণ ডন রয়েছে মুক্তিকামী জনতার অবচেতনে । ডনের অবস্থান শ্রমিক , কৃষক ও খেটে খাওয়া লাখো কোটি মানুষের স্বপ্নে , মননে , হৃদয়ের গভীরে ।

আমাদের দেশের ৪০ শতাংশ সম্পদ রয়েছে মাত্র ১ শতাংশ ধনী মানুষের কব্জায় । কিন্তু হায় , এদেশে ডন কিহোতে কোথায় ? মধ্যবিত্তের নিশ্চিন্ত নিরাপদ জীবন যাপনের কল্পনায় ডন হামলা করে মাঝেমধ্যে লজ্জা দিয়ে যায় বটে , কিন্তু ওই পর্যন্তই । ডন রয়ে গেছে সাহিত্যে , গানে , থিয়েটারে ও বক্তৃতায় । তার উদ্ভট সব কাণ্ডকারখানায় মাঝেমাঝে কেঁপে উঠলেও রাষ্ট্র বেশ জানে যে , ডন একা , তাকে সঙ্গ দেবে না কেউ , সে ভীষণ একা , আর যতদিন ডন একা , ততদিন রাষ্ট্র সম্পূর্ণ নিরাপদ ।

 

আরও পড়ুন- অভিষেকের মামলার ভুল ব্যাখ্যা: সুপ্রিম নোটিশে সত্য প্রকাশ্যে, কী বলবে কু.ৎসাকারীরা!