‘নিঃসঙ্গ শিক্ষক’, উৎপল সিনহার কলম

0
3
উৎপল সিনহা

মাকড়সা আটটা পা
বাইরে যা জাল বিছা ।
ঘরকুনো আর কেন
একভাবেই রোজ বাঁচা !
কাল রাতে আলনাতে
ঝুলগুলো ঝুলছিলো
তাই দেখে ভাই রেগে
কাই হলো যাই বলো ।
ঝুল হলে ঝুলঝাড়াও
ঝাল ঝাড়ে , ঠিক কিনা ?
তাই বলে ভুল করেও
ভুলবি না জাল বোনা ।
মাকড়সা যুদ্ধে যা
রবার্ট ব্রুশ পারছে না !
বড়াই না ; দেখিয়ে দে
শিখিয়ে দে লড়াইটা ।

মাকড়সা গা ঘিনঘিনে ? ওকে ছুঁলেই জাত যায় ? জাত কি ছেলের হাতের মোয়া ! মাকড়সা বিষাক্ত ? ঠিক আছে । একটু দূরে থাকা যেতেই পারে , কিন্তু মাকড়সাকে কিছুতেই অবজ্ঞা করা যাবে না । এর অনেক অবদান বিশ্বপ্রকৃতিতে ।
আর , বিশ্বজুড়ে স্পাইডার ম্যান নিয়ে যে হৈচৈ , উন্মাদনা,
তা কোনোভাবেই কি সম্ভব হতো মাকড়সা না থাকলে ?
রবার্ট ব্রুশের যুদ্ধজয়ের প্রধান প্রেরণা মাকড়সা নিয়ে কত যে গল্প আর কল্পকাহিনী !

মাকড়সার একটা বিশেষ গুণ হলো আঠালো জাল বুনতে পারার ক্ষমতা এবং সেই জালে অন্যান্য কীটপতঙ্গ ইত্যাদি বন্দী করে শিকার করে এরা । অনেক রকমের মাকড়সা হয় । কেউ জাল বোনে , কেউ লাফিয়ে শিকার ধরে । সব মাকড়সার একজোড়া বিষগ্রন্থি আছে । এরা প্রথমে শিকারকে জালবন্দী করে , তারপর বিষাক্ত দাঁড়া দিয়ে হত্যা করে ।

মাকড়সা কিন্তু পতঙ্গ নয় । এদের শরীরে কোনো পাখা নেই , অ্যানটেনাও নেই । এরা অ্যারাকনিডা শ্রেণীর অ্যারানি বর্গের সদস্য । এদের পায়ের সংখ্যা আট । মাকড়সার জাল টানলে অনেক লম্বা হয় , কিন্তু সহজে ছেঁড়ে না । এই জালের প্রসারিত হওয়ার ক্ষমতা স্টিলের চেয়েও বেশি । পা এবং পদক্ষেপের কৌশলের কারণে এরা নিজেদের জালে নিজেরা আটকে যায় না । এদের শরীরে রয়েছে বিশেষ ধরনের রাসায়নিক ।

পৃথিবীতে প্রায় ৫০ হাজার প্রজাতির মাকড়সা রয়েছে । দূরের কোনোকিছুই স্পষ্ট দেখতে পায় না এরা । তবু মাকড়সা দেখলেই সবাই দূরে সরে যায় । মাকড়সার পেশী নেই । এরা চলাফেরা করে হাইড্রোলিক পাওয়ার ব্যবহার ক’রে , অর্থাৎ এদের পা-গুলো শরীরের ভেতরকার এক বিশেষ তরলের মাধ্যমে চলে ।

মাকড়সা উপকারী প্রাণী । এরা পোকামাকড় খেয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে । প্রাণী হিসেবে এরা যথেষ্ট চিত্তাকর্ষক। শুনলে অবাক হতে হয় যে , পিতা মাকড়সা খুব হিংস্র হয়ে ওঠে অন্য মাকড়সাদের প্রতি । মাকড়সা কখনও ভিজে যায় না । এরা বাথরুমে থাকতে বেশি পছন্দ করে , কারণ এদেরও তৃষ্ণা আছে । এদের পাকস্থলী শুধুমাত্র তরল খাদ্য গ্রহণ করতে পারে । খাওয়ার আগে এরা খাদ্যকে দ্রবীভূত করে নেয় । এদের দেহ পাতলা জালের মতো রোঁয়া-আবৃত । তাই এরা ভেজে না । জলের মধ্যেও বেঁচে থাকতে পারে । ব্ল্যাক উইডো মাকড়সাদের মধ্যে স্ত্রী মাকড়সা সঙ্গমের পর পুরুষ মাকড়সাটিকে খেয়ে ফেলে । অবশ্য ক্ষুধার্ত না থাকলে কখনো কখনো পুরুষ মাকড়সাটি রক্ষা পায় । আবার কখনো কখনো এও দেখা যায় যে , পুরুষ মাকড়সা নিজেই স্ত্রী মাকড়সার মুখে নিজেকে সমর্পণ করে দেয় তাকে খেয়ে ফেলার জন্য । বেশিরভাগ মাকড়সার ৬ থেকে ৮ টি চোখ থাকে ।

মাকড়সার জাল শক্তিশালী প্রোটিনের সুতো দিয়ে তৈরি হয় । এই জাল ভীষণ শক্ত । মাকড়সার পা ১২ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হতে পারে । সবচেয়ে বড় মাকড়সার ওজন ১৫০ গ্রামের বেশিও হতে পারে । ৩১৮ মিলিয়ন বছর আগে কার্বনিফেরাস শিলায় মাকড়সার জীবাশ্ম পাওয়া গেছে । সবচেয়ে বিষাক্ত মাকড়সা ব্ল্যাক উইডো উত্তর আমেরিকায় পাওয়া যায় । তবে এও জানা যায় যে , অস্ট্রেলিয়ান ফানেল-ওয়েব স্পাইডারের বিষে আক্রান্ত হলে একজন মানুষ এক ঘন্টার কম সময়ে মারা যেতে পারে । বেশিরভাগ মানুষ মাকড়সাকে ভয় পায় । এই ভয়ের মাত্রা যখন বেড়ে যায় তখন মাকড়সার ছবি দেখলেও ভীতি জাগে । এই ভীতিকে ‘ আর্কনোফোবিয়া ‘ বলা হয় । নানা প্রজাতির,নানা আকার ও আকৃতির এবং বিভিন্ন দৈর্ঘ্য ও ওজনের মাকড়সা আছে । এদের গায়ের রঙেও ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায় ।

ট্যারান্টুলা মাকড়সা নেকড়ে মাকড়সার শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত । ইতালি ও স্পেনে এদের পাওয়া যায় । এরা খুব বিষাক্ত ও বিপজ্জনক ।

আবার এও সত্য যে , মাকড়সার জালের মধ্যে রয়েছে ক্ষত নিরাময়ের অসামান্য ক্ষমতা , কারণ এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন কে রয়েছে , যা দ্রুত রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে । এই জালের অ্যান্টিসেপটিক ও অ্যান্টি ফাঙ্গাল ক্ষমতাও রয়েছে । এটা লিগামেন্টের চোট পর্যন্ত সারিয়ে দিতে পারে । এমনকি অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রেও এর জুড়ি নেই । মাকড়সা লড়াই , নিষ্ঠা , অধ্যবসায় এবং কঠোর পরিশ্রমের প্রতীক । এদের জীবন ও কর্ম মানবজাতির কাছে প্রেরণাদায়ক । কীট তথা প্রাণীকুলের বিরলতর এই ‘ তাঁতশিল্পী ‘ যথেষ্ট অবদান রেখে চলেছে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় । মাকড়সা নিয়ে বিশ্বজুড়ে গবেষণার শেষ নেই । সভ্যতা যত এগিয়ে চলেছে ততই যেন আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে মানবজাতির এই ‘ নিঃসঙ্গ শিক্ষক ‘ ।

আরও পড়ুন- চারধাম প্রকল্প নিয়ে ভোটের রাজনীতি করতে গিয়েই বি.পদের শ.ঙ্কা, ৫ বছরে ২০টি ধ.স