এক-আধদিন নয়, টানা দু’বছর ধরে নিখুঁত পরিকল্পনা করে ৭ অক্টোবর হামলা চালানো হয়েছিল ইজরায়েলের মাটিতে। সেই মারণ হামলায় মৃত্যু হয়েছিল ১৪০০ জনের। আড়াইশো জনের বেশি মানুষকে করা হয় পণবন্দি। এই নৃশংস হামলার মূলে ছিল হামাসের শীর্ষ নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার। দু বছর আগে এই হামাস নেতা ইজরায়েলের আধিকারিকদের আশ্বস্ত করেছিল, তারা আর যুদ্ধের পথ চায় না। অর্থনৈতিক উন্নতির পথে হেঁটে গাজাকে দুবাই বা সিঙ্গাপুরের মত গড়ে তুলতে চায়।
জানা যাচ্ছে, ধাপে ধাপে ইজরায়েলকে এই নেতা আশ্বস্ত করে যে তারা যুদ্ধের পথ থেকে বেরিয়ে এসে একটি শান্তিপূর্ণ, উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে উঠবে। অবশ্য হামাসের শীর্ষ নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ারের কথায় বিশ্বাস করার পরিণতি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে ইজরায়েল। পাল্টা হামলায় গাজাকে কার্যত কবরস্থানে পরিণত করা হলেও ইজরায়েলের মূল টার্গেট এখন সিনওয়ার। প্রধান শত্রুকে খুঁজে বের করে খতম করতে উঠেপড়ে লেগেছে ইজরায়েল সেনা। জানা যাচ্ছে, গাজার কোনও এক গুপ্ত সুড়ঙ্গে হিটলারের মত লুকিয়ে রয়েছে এই জঙ্গি নেতা। রিপোর্ট বলছে, হামাসের শীর্ষ নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার অত্যন্ত কম কথা বলেন এবং ধুরন্ধর বুদ্ধিমান। এই যুদ্ধের পরিকল্পনা সিনওয়ারের মাথায় আসে যখন সে দেখে ইজরায়েল প্যালেস্টাইন থেকে নজর সরিয়ে সিরিয়া ও ইরান সমস্যাকে অধিক গুরুত্ব দিতে শুরু করেছে। পাশাপাশি গাজা থেকে বেশিরভাগ সেনা সরিয়ে তাদের ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে ইজরায়েলের বসতিপূর্ন এলাকার নিরাপত্তায় মোতায়েন করেছে। পরিস্থিতি বুঝে নিয়েই সিনওয়ার ছক কষে নেয়।
পরিকল্পনামাফিক সিনওয়ার ইজরায়েলকে জানায়, গাজায় বেকারত্ব দূর করতে ১৮ হাজার কর্মীর কাজের পারমিট জারি করা উচিত ইজরায়েলের। ভালোভাবেই সেই বার্তা গ্রহণ করে ইজরায়েল। আর সেটাই ছিল ইজরায়েলের সবচেয়ে বড় ভুল। এই আঠারো হাজার কর্মী সীমান্ত পেরিয়ে ইজরায়েলে নানান ধরনের কাজ করতো। কাজের ফাঁকেই চলতো গুপ্তচরবৃত্তি। সীমান্তবর্তী ইজরায়েলের এলাকার ভিডিও ও ছবি তুলে পাঠানো হতো গাজায়। ওই সমস্ত এলাকার নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয় খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করত গাজার শীর্ষ হামাস নেতারা। শুধু তাই নয়, ওই সমস্ত জায়গায় যে সমস্ত ইজরায়েলি বাসিন্দা বসবাস করেন তাদের তালিকা তৈরি করে বিশদ খোঁজখবর নেওয়া হয় গোপনে। নিখুঁত পরিকল্পনা সাজিয়ে ফেলার পর ইরানের কাছ থেকে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র যোগাড় করে হামাস। হামলার কয়েক সপ্তাহ আগে এই পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত প্রত্যেক জঙ্গির মোবাইল ফোন ইন্টারনেট ও সমস্ত রকম ইলেকট্রনিক ডিভাইসের ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়া হয়, যাতে ইজরায়েলের গোয়েন্দা বিভাগ এই হামলার কোনরকম আঁচ না করতে পারে। এরপর ৭ অক্টোবর অতর্কিতে হামলা চালানো হয়।
কে এই ইয়াহিয়া সিনওয়ার?
দক্ষিণ গাজার খান ইউনিস শহরের একটি দরিদ্র এলাকায় জন্মগ্রহণ করে ইয়াহিয়া সিনওয়ার। ১৯৮০-র দশকের শেষদিকে হামাসের সামরিক শাখা প্রতিষ্ঠার অন্যতম সহায়ক ছিল এই ব্যক্তি। এরপর ইজরায়েলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গাজায় কর্মরত প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠী প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের নেতাদের হত্যা করতে শুরু করে সিনওয়ার এবং নিজের ৪ সহযোগীকেও হত্যা করে সে। যার জেরে ১৯৮৯ সালে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। জেলে থাকা অবস্থায়তেও সিনওয়ার প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠনের নেতাদের হত্যা করতে থাকে। ২০০০ সালের শুরুর দিকে জেলে থাকাকালীন মাথাব্যথা এবং দৃষ্টি ঝাপসা হওয়ার মতো সমস্যা শুরু হয় সিনওয়ারের। জানা যায়, তার ব্রেন টিউমার হয়েছে। এরপর ইজরায়েলের বেরশেবার সোরোকা মেডিকেল সেন্টারে ব্রেন অপারেশন করে প্রাণ বাঁচানো হয় সিনওয়ারের।
সিনওয়ারের প্রাণ রক্ষার পর ইজরাইলের তরফে তাকে প্রস্তাব দেওয়া হয় ইজরায়েলের এজেন্ট হওয়ার। যদিও সেই সময় এর কোন উত্তর না দিয়ে নিজের মুক্তির আবেদন জানায় এই হামাস নেতা। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ইজরায়েলের সেনা অফিসার গিলাদ শালিতকে অপহরণ করে এবং তার মুক্তির বিনিময়ে এক হাজার প্যালেস্তানি বন্দীর মুক্তি দাবি করে সিনওয়ার। আমাদের দাবি মত চাপের মুখে পড়ে ২০১১ সালের ১৮ অক্টোবর এক হাজার প্যালেস্তানি জঙ্গিকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় ইজরায়েল। এরপর থেকেই গাজায় সক্রিয় হয়ে ওঠে হামাস। ২০১৭ সালে, তিনি ইসমাইল হানিয়াহের জায়গায় হামাসের সর্বোচ্চ নেতা নির্বাচিত হন সিনওয়ার। এর পর থেকে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে একের পর এক হামলার পরিকল্পনা শুরু করে হামাস যার সর্বশেষ নিদর্শন ৭ অক্টোবর। এই হামলার পর (ইজরায়েল হামাস যুদ্ধ) থেকে এখনও পর্যন্ত ইয়াহিয়া সিনওয়ার আজ পর্যন্ত কোনো বিবৃতি দেননি। এমনকি তাকে প্রকাশ্যে কোথাও দেখাও যায়নি। মনে করা হচ্ছে, সিনওয়ার তার বিশ্বস্ত সঙ্গীদের নিয়ে গাজার কোনো গোপন সুড়ঙ্গে লুকিয়ে আছে। যাদের শেষ করতে লাগাতায় লাগাতার গাজায় অভিযান চালাচ্ছে ইজরায়েলি সেনা।