
দুপুর থেকে সন্ধ্যা রূপকথার গল্প । রাতে রূপান্তরের গান । আরব সাগরের তীরে মায়াবী আলোয় লেখা হলো ক্রিকেটের নয়া ইতিহাস । মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে ৭ নভেম্বরের এই ম্যাচ যাঁরা স্বচক্ষে দেখলেন তাঁরা সকলেই ভাগ্যবান ।
গল্পটা সাধারণ কিন্তু অসামান্য । টসে জিতে ব্যাটিং করল আফগানিস্তান । তুললো ৫ উইকেটে ২৯১ রান । ২০২৩ বিশ্বকাপের ৩৯-তম ম্যাচ । সেমিফাইনালে ওঠার লড়াই । জবাবে ৭ উইকেটে ২৯৩ তুলে ম্যাচটা ৩ উইকেটে জিতলো অস্ট্রেলিয়া । এ পর্যন্ত গল্পটা বেশ চেনা চেনা । এমন তো কতই হয় । কেউ জেতে কেউ হারে । কিন্তু এই ম্যাচের মূল কাহিনীর বুকে রয়ে গেলো এমন কিছু চমকপ্রদ ঘটনা , যা সচরাচর ঘটে না ।
ক্রিকেটে উদীয়মান শক্তি আফগানিস্তান । নানা সমস্যায় জর্জরিত তথা দুর্বল ক্রিকেট পরিকাঠামো সত্ত্বেও তাদের এই উত্থান সত্যিই বিস্ময়কর । এই মুহূর্তে ক্রিকেট বিশ্বের যে কোনো শক্তিকে পরাজিত করার ক্ষমতা অর্জন করেছে তারা । চলতি বিশ্বকাপেই একাধিকবার দৈত্য সংহার করে সংবাদের শিরোনাম হয়েছে আফগানিস্তান ।
বিপক্ষে ছিল পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া । এ ম্যাচে স্পিনার অলরাউন্ডার রশিদ খানের ১৮ বলে ৩৫ রান ছাড়া তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো দু’অঙ্কের রান আফগানদের স্কোরবোর্ডে না থাকলেও একটা তিন অঙ্কের রান আফগান ক্রিকেটের ধ্রুবতারা হয়ে জেগে রইলো । একসময় আফগানরা আড়াইশো ছুঁতে পারবে কিনা তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছিল । সেই অবস্থা থেকে দলকে ২৯১ রানের লড়াকু স্কোরে পৌঁছে দিলেন ইব্রাহিম জাদরান । বয়স মাত্র ২১ । মাত্র ১৪৩ বলে ১২৯ রানের অনবদ্য ইনিংস খেললেন তিনি । ৮ টি চার ও ৩ টি ছক্কায় মাতালেন মাঠ । মনে পড়ালেন তোরাবোরা পাহাড় । শের আফগান । বীর আফগান । ইতিহাস রচনা করলেন জাদরান । বিশ্বকাপের ইতিহাসে তিনিই হলেন প্রথম শতরানকারী আফগান ক্রিকেটার । যদিও এই বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়া এখনও পর্যন্ত তাদের চিরাচরিত আগ্রাসী মেজাজে নেই । হেরেওছে বেশ কয়েকটি ম্যাচ । তবু হারার আগে কিছুতেই হার না মানা লড়াই ক্যাঙারুদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে । সেই অদম্য দলকে প্রায় একাই খাদের কিনারায় ঠেলে দিলেন মাত্র ২১ বছর বয়সী এক আফগান যুবা । আর ইতিহাসের বরণমালা গলায় ঝুলিয়ে মাথা নিচু করে সুপরামর্শ পাওয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা জানালেন একজনের প্রতি । কে তিনি ? সচিন তেন্ডুলকর । ইতিহাস স্যালুট জানালো ইতিহাসকে । তারপর ?
বিরতির সময় প্রায় সকলের মুখেই শোনা গেল অস্ট্রেলিয়ার আর একটা পরাজয় শুধু সময়ের অপেক্ষা । কিন্তু ক্রিকেট দেবতা বুঝি আড়ালে হাসছিলেন তখন । তিনি কখন কার প্রতি প্রসন্ন হবেন তা শুধু তিনিই জানেন ।
অনিশ্চয়তায় মোড়া ক্রিকেট পণ্ডিতদের বারবার বোকা বানানোর জন্য বিশেষ প্রসিদ্ধ । এখানেও কি তেমন কিছু হবে ? ব্যাট করতে নেমে একের পর এক উইকেট পড়তে লাগলো ক্যাঙারুদের । বিখ্যাত ব্যাটাররা প্রায় সবাই প্যাভিলিয়নে ফিরে গেলেন । মাত্র ৪৯ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে তখন তারা থরহরিকম্প । মাঠে নামলেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল । যাঁর ডাকনাম ম্যাক্সি । তখন কে-ই বা জানতো এই ম্যাক্সিই আজ হয়ে উঠবেন ম্যাক্সিমাম !
আমরা দেখলাম ম্যাক্সির শান্ত দুটি চোখে স্বপ্নের দূরবীন । মাথা লেটুস পাতার মতো ঠাণ্ডা । আর বুকের ভেতরটা নিশ্চয় অস্ট্রেলীয় অস্মিতায় আগুনময় । মুখে স্মিত হাসি । আচরণে বরাবর নম্র । তিনি ক্রিজে আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই আরো কয়েকটি উইকেট পড়লো । ১৮.৩ ওভারে আউট হলেন মিচেল স্টার্ক । অজিরা তখন ৭ উইকেটে মাত্র ৯১ । নামলেন প্যাট কামিন্স । গোটা ক্রিকেটবিশ্ব ধরে নিয়েছে অজিদের হার অবধারিত । কিন্তু ম্যাক্সির আচরণে অটল প্রত্যয় । যদিও তাঁর শরীরে ক্লান্তি যথেষ্ট । মনে রাখতে হবে ব্যাট করতে আসার আগে প্রায় চার ঘণ্টা টানা ফিল্ডিং করেছেন ম্যাক্সি এবং ১০ ওভার হাত ঘুরিয়ে ৫৫ রানের বিনিময়ে ১ টি উইকেটও পেয়েছেন । ৯১ রানে ৭ উইকেট হারানোর পর মনকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ রাখা ভীষণ শক্ত । দীর্ঘদূর যাত্রাপথে মাত্র কয়েকজন বোলার সঙ্গী । তাই নিয়েই শুরু করলেন অসম এক লড়াই । প্রায় একক লড়াই ।
এমন দুঃসময়ে আবার গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো উপস্থিত হলো আরেক বিপদ । একপায়ে টান ধরলো ম্যাক্সির । পেশীর টান , মাসল ক্র্যাম্প । খোঁড়া পা নিয়েই খেলতে লাগলেন । এক পায়ে দাঁড়িয়ে সব গাছ ছাড়িয়ে তালগাছের মতো আকাশ ছোঁয়ার ইচ্ছেটা কিছুতেই মরতে দিলেন না ।
দুপুর থেকে সন্ধে পর্যন্ত ওয়াংখেড়ে ভেসেছিল ‘ জাদরানি ‘ ঝোড়ো হাওয়ায় । রাতে তছনছ হয়ে গেলো ‘ ম্যাক্সি ‘ ঝড়ের তাণ্ডবে । অসহ্য যন্ত্রণা চেপে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে মাত্র ১২৮ বলে ২০১ রানের মহাকাব্য রচনা করে দেশকে ৩ উইকেটে জিতিয়ে বীরদর্পে মাঠ ছাড়লেন ম্যাক্সি । রেখে গেলেন সোনায় মোড়া ২১ টি চার ও ১০ টি ছয় । জিতলো ক্রিকেট । অস্তরাগে রচিত রূপকথা কয়েক মুহূর্তের জন্য ম্রিয়মান হলো রাতের মায়াবী অরূপগাথার ইন্দ্রজালে । মূলতান যেন কিছুটা বিপন্ন বোধ করলো ইমনের অপরূপ মূর্ছনায় । আর এই মায়ার খেলায় মুগ্ধ বিস্ময়ে আট ঘণ্টা মজে রইলো ক্রিকেট দুনিয়া ।
ক্রিকেট তো মাত্র এক বলের খেলা । কিন্তু ক্রিকেট কি একজনের খেলা ? আমরা তো অস্ট্রেলিয়ার ৯১ রানে ৭ উইকেট পড়ার পর থেকে মাঠে এক ও একমাত্র ম্যাক্সি ছাড়া আর কাউকেই প্রায় দেখতে পাচ্ছিলাম না । যেদিকে তাকাই শুধু ম্যাক্সি আর ম্যাক্সি । আহা , দু’চোখ ভরে দেখলাম ‘ ম্যাক্সওয়েল শো ‘ ! ভুলবো না ।
খেলায় হারজিত থাকবেই । আফগানিস্তান পরাজিত । অস্ট্রেলিয়া জয়ী । কিন্তু ক্রিকেটপ্রেমীদের মনের মণিকোঠায় চিরদিনের জন্য রয়ে যাবে দুই অনন্য ক্রিকেটযোদ্ধার যৌথ বীরগাথা , যার স্রষ্টা যথাক্রমে ইব্রাহিম জাদরান এবং গ্লেন ম্যাক্সওয়েল ।
আরও পড়ুন- ১৩০ কিমি বেগে ছুটছে পুরুষোত্তম এক্সপ্রেস, আচমকা ঝা.কুনি! তারপর…