টাকা ও উপহারের বিনিময়ে সংসদে প্রশ্ন তোলার অভিযোগে কোনও প্রমাণ ছাড়া, একতরফা ভাবে স্পিকার কাছে মহুয়া মৈত্রের সংসদ পদ খারিজের প্রস্তাব দিয়েছে এথিক্স কমিটি। সংসদে এহেন ঘটনা অবশ্য প্রথমবার নয়, সাংসদদের নীতি নিয়ে বিজেপি যখন বাতেলা দিচ্ছে তখন একবার ফিরে দেখা যাক বিজেপিি অতীতে। যেখানে একাধিক বিজেপি সাংসদকে ক্যামেরার সামনে টাকা নিতে দেখা যায়। অভিযুক্ত সাংসদদের সাংসদ পদ খারিজের প্রস্তাব উঠলে, বিজেপি সাংসদ লালকৃষ্ণ আদবানী কংগ্রেস সরকারের দুরমুশ করে এই ঘটনাকে মৃত্যুদণ্ডের সঙ্গে তুলনা করে।
ফিরে যাওয়া যাক ১৮ বছর পিছনে। তখন দেশে মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার। গোটা দেশে সাড়া ফেলে দিল ডিজিটাল পোর্টাল কোবরা পোস্টের এক স্টিং অপারেশন। নাম ছিল, অপারেশন দুর্যোধন। ৫৬টি ভিডিও, ৭০টি অডিওটেপ এবং ৯০০টি ফোন কল। ৮ মাস ধরে এই অপারেশন চালিয়ে কোবরা পোস্ট প্রকাশ্যে আনে অর্থের বিনিময়ে সাংসদে প্রশ্ন তোলা একাধিক বিজেপি সাংসদের কীর্তি। কোবরা পোস্টের সাংবাদিক অনিরুদ্ধ বাহল ও সুহাসিনী রাজ ‘নর্থ ইন্ডিয়ান স্মল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (NISMA)’ নামে একটি কাল্পনিক লবিং সংস্থার জন্ম দেন। আর সেখানে বিপুল অর্থের বিনিময়ে কয়েকজন সাংসদ দলীয় লাইন না-মেনে সংসদে প্রশ্ন করতেও রাজি হয়েছিলেন। এই সাংসদরা হলেন- বিজেপির ছতরপাল সিং লোধা, আন্না সাহেব এম কে পাতিল, চন্দ্রপ্রতাপ সিং (সিধি, মধ্যপ্রদেশ), প্রদীপ গান্ধী, সুরেশ চান্দেল এবং জি মহাজন। এছাড়াও, তিনজন বিএসপি সাংসদও কোবরা পোস্টের শিকার হয়েছিলেন। তাঁরা হলেন, নরেন্দ্রকুমার কুশওয়াহা, লালচন্দ্র কোল এবং রাজা রামপাল এবং আরজেডির মনোজ কুমার এবং কংগ্রেসের রামসেবক সিং। এর মধ্যে লোধা ছিলেন রাজ্যসভার সাংসদ।
২০০৫ সালের ১২ ডিসেম্বর, আজতক টিভি চ্যানেল স্টিং থেকে ভিডিও ফুটেজ সম্প্রচার করে। যেখানে দেখা যায় সাংসদরা সংসদে প্রশ্ন তুলতে রাজি হয়েছেন এবং টাকা নিচ্ছেন। ভিডিও প্রকাশ্যে আসার পর সংসদীয় কমিটি গঠন করেন লোকসভার স্পিকার। কমিটিতে ছিলেন সাংসদ পবনকুমার বনসল (চেয়ারম্যান, কংগ্রেস), বিজয়কুমার মালহোত্রা (বিজেপি), মহম্মদ সেলিম (সিপিএম), রামগোপাল যাদব (সমাজবাদী পার্টি) এবং সি কুপ্পুসামি (কংগ্রেস)। তবে বিজেপি সাংসদ মালহোত্রা সাংসদদের বহিষ্কারের তীব্র বিরোধিতা করেন। তার বক্তব্য ছিল, সংসদ নয়, আদালতে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
যদিও কমিটির ফলাফলের ভিত্তিতে, তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় ২৩ ডিসেম্বর একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন, ১০ জন লোকসভা সাংসদের আচরণ ‘অনৈতিক এবং সংসদ সদস্য হিসেবে অযাচিত। সেই জন্য তাঁরা লোকসভার সদস্য হিসেবে বহাল থাকার অযোগ্য। তার প্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, ওই সাংসদদের লোকসভার সদস্যপদ থেকে বহিষ্কার করা হবে। সেই প্রস্তাব গৃহীত হয়। কিন্তু, বিজেপি বিক্ষোভ দেখায়। বিজেপি সদস্যরা সংসদ থেকে ওয়াক আউট করেন। খোদ তৎকালীন বিরোধী দলনেতা এলকে আদবানি সাংসদদের বহিষ্কারকে, ‘মৃত্যুদণ্ড’র সঙ্গে তুলনা করেন। অভিযুক্ত সাংসদদের মধ্যে লোধা ছিলেন রাজ্যসভার সাংসদ। রাজ্যসভাও পরে লোধাকে বহিষ্কার করেছিল। সাংসদ করণ সিংয়ের নেতৃত্বে সংসদের নীতি কমিটির তদন্তের পরে, সংসদ ভবনের ‘সর্বোচ্চস্তরের সম্মান ও মর্যাদা রাখার জন্য’ এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
স্পষ্ট প্রমাণ ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ্যে আসার পরও সেদিন নিজের দলের নেতাদের সাংসদ পদ খারিজের বিরুদ্ধে সুর চড়াতে কোনও খামতি রাখেনি বিজেপি। অথচ আজ উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া শুধুমাত্র একজনের অভিযোগের ভিত্তিতে তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্রের সাংসদ পথ খারিজ করতে উঠে পড়ে লেগেছে ক্ষমতার অলিন্দে বসে থাকা মোদি-শাহের সরকার। শুধুমাত্র সাংসদে বিজেপির ‘পাপ’ তুলে ধরে তাদের ল্যাজে গোবরে করার জন্য। মহুয়ার ভবিষ্যৎ নির্ধারিতভাবে ৪ তারিখ থেকে শুরু হওয়া শীতকালীন অধিবেশনে। তবে তার আগে এই পাল্টি-খোর বিজেপি খুঁড়ে দেখুক তার নিজের অতীত।