‘অন্যতম তিমিরবিনাশী’, উৎপল সিনহার কলম

0
2
উৎপল সিনহা

‘ … আমাদের সমালোচনা করার সময় এটুকুও ভেবো যে , কোন্ এক অন্ধকারে আমরা বেঁচেছিলাম , যে অন্ধকার থেকে তোমরা বেঁচে গেছো ‘ ।

এখন তো ভারতীয় ক্রিকেটের স্বর্ণযুগ । সারাক্ষণ ঝলমলে আলোর রোশনাই । বিশ্ব ক্রিকেটের সমীহ জাগানো শক্তি ভারত , তেমনই প্রভাবশালী । কিন্তু বিষান সিং বেদীদের সময়টা ছিল ভারতীয় ক্রিকেটের প্রায় অন্ধকার যুগ । ব্যাটিং তেমন শক্তিশালী ছিল না । ফিল্ডিং ছিল জঘন্য । আর পেস বোলিং তো দূরের কথা , মিডিয়াম পেসার বলতেও তেমন কেউ ছিলেন না । তখন অনেক ম্যাচেই বোলিং ওপেন করতে হতো স্পিনারদের । সেই দিশাহীন সময়ে বিশ্বের দরবারে ভারতীয় ক্রিকেটকে একটা সম্মানজনক প্রতিষ্ঠা দেওয়ার প্রাণপন সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন যে সমস্ত ক্রিকেটযোদ্ধা , তাঁদের একেবারে প্রথম সারিতে ছিলেন ঘূর্ণিবলের জাদুকর বিষাণ বেদী ।

গত ২৩ অক্টোবর ( ২০২৩ ) তিনি চলে গেলেন পৃথিবী ছেড়ে । বয়স হয়েছিল সাতাত্তর । জন্মেছিলেন ১৯৪৬ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর , অমৃতসরে । ধীরগতির বাঁহাতি এই অর্থোডক্স বোলার ৬৭ টেস্টে উইকেট পেয়েছেন ২৬৬ টি । ১০ টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে পেয়েছেন ৭ টি উইকেট । ২২ টি টেস্ট ম্যাচে দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন । ১৯৬০ ও ১৯৭০- এর দশকে এরাপল্লি প্রসন্ন , ভাগবত চন্দ্রশেখর ও শ্রীনিবাসন ভেঙ্কটরাঘবনকে নিয়ে বিশ্বক্রিকেটে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন স্পিন আধিপত্য । ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৯ তাঁর ক্রিকেট কেরিয়ারের সময়কাল । প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে তাঁর মোট উইকেটের সংখ্যা ১৫৬০ । ইংল্যান্ডে কাউন্টি ক্রিকেটেও তাঁর কেরিয়ার তথা সাফল্য বিস্ময়কর । ১৯৭২ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত সেখানে খেলেন নর্থহ্যাম্পটনশায়ারের হয়ে এবং ৪৩৪ টি উইকেট পান ১০২ ম্যাচে । ১৯৭৬ সালে পোর্ট অফ স্পেন-এ ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সেই সিরিজের তৃতীয় টেস্টে চতুর্থ ইনিংসে রেকর্ড ৪০৬ রান তুলে স্মরণীয় জয় পায় ভারত তাঁরই নেতৃত্বে । উপমহাদেশের স্পিন বোলিংয়ের অন্যতম এই প্রাণপুরুষের হাত ধরেই স্পিন বোলিংয়ে বিপ্লব আসে ভারতের ক্রিকেটে । কিন্তু এই সমস্ত চুলচেরা পরিসংখ্যান দিয়ে বিষান সিং বেদী-র মতো ঠোঁটকাটা , আপসহীন , ডাকাবুকো ও স্পষ্টবক্তা স্পিনশিল্পীকে ধরা যাবে না । বিশ্বক্রিকেটের অন্যতম বর্ণময় ক্রিকেটার বিষান বেদী ছিলেন মানুষ হিসেবেও সিংহহৃদয় ।

শেন ওয়ার্ন থেকে অনিল কুম্বলে , সকলেই উপকৃত হয়েছেন বেদীর মূল্যবান পরামর্শে । চিরকালের বিতর্কিত বেদী ছিলেন বিশ্বক্রিকেটের অন্যতম আকর্ষণীয় চরিত্র । আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি উইকেটের মালিক মুথাইয়া মুরলিধরনকে বেদী বলেছেন ‘ বর্শাবাহক ‘ , ‘ চাকার ‘ । আবার সুনীল গাভাস্কারের তীব্র বিরোধী বলে পরিচিত এই মানুষটিকে যখন তাঁর দেখা সেরা ব্যাটসম্যানের নাম বলতে বলা হয়েছিল তখন এক মুহূর্তও না ভেবে জবাব দিয়েছিলেন , ‘ আমার দেখা সেরা ব্যাটসম্যানের নাম সুনীল গাভাস্কার ‘ ।
১৯৯০-এ কোচ হয়েছিলেন ভারতীয় ক্রিকেট দলের । সেখানেও বিতর্ক । একটি সফরে ভারত খারাপ খেলায় তিনি বলেছিলেন , ‘ গোটা দলকে সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলা উচিত ‘ ।

শুধু বিপক্ষ দল নয় , বেদীরা যখন খেলতেন তখন দেশে দেশে দেশপ্রেমী আম্পায়ারদের সঙ্গেও লড়তে হতো ক্রিকেটারদের । প্রচুর অবিচার চলতো মাঠে ও মাঠের বাইরে । মুখে বলা হতো ‘ ক্রিকেট ভদ্রলোকের খেলা ‘ , কিন্তু কার্যক্ষেত্রে প্রচুর অভদ্রতা দেখা যেতো । মাঠে চলতো নানা ধরনের চালাকি , প্রতারণা , অনিয়ম ও বেনিয়ম । বেদী নিজে ছিলেন নিপাট ভদ্রলোক , তাই মাঠে কোনো ধরনের অভদ্রতা তিনি বরদাস্ত করতেন না । তাঁর মতো সাহসী ও প্রতিবাদী ক্রিকেটার বিশ্ব-ক্রিকেটে খুব বেশি খুঁজে পাওয়া যাবে না । শাস্তির ঝুঁকি আছে , এমনকি নিজের অধিনায়কত্ব ও ক্রিকেট কেরিয়ারকে বাজি রেখেও বারবার ক্রিকেট মাঠে অন্যায়ের প্রতিবাদ করে গেছেন এই ডাকাবুকো মানুষটি ।

১৯৭৬ সালে চার পেসার নিয়ে দুরন্ত ওয়েস্ট ইন্ডিজ ভারতীয় ব্যাটারদের শরীর লক্ষ্য করে লাগাতার বাউন্সার দেওয়ায় কয়েকজন আহত হন । অতিরিক্ত বাউন্সার দেওয়ার প্রতিবাদে অধিনায়ক বেদী ৩০৬ রানে ইনিংস ডিক্লেয়ার করে দেন । দ্বিতীয় ইনিংসেও মাত্রাতিরিক্ত বাউন্সারে কয়েকজন চোট পেলে মাত্র ২ টি উইকেট হারানোর পর ইনিংস ডিক্লেয়ার করে দেন বেদী । ক্রিকেটাররা বেঁচে যান কিন্তু ভারত হেরে যায় । সমালোচনার ঝড় ওঠে সারা দেশে । কিন্তু বেদী সেসবের পরোয়া করেন নি । দলের খেলোয়াড়দের বাঁচানো এবং অন্যায়ের প্রতিবাদ করাই সেই মুহূর্তে তাঁর কাছে প্রধান কর্তব্য বলে মনে হয়েছিল ।

১৯৭৮ সালে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে পাকিস্তান দল অসততা অবলম্বন করায় প্রায় জেতা ম্যাচ ছেড়ে মাঠ থেকে দল তুলে নিয়েছিলেন অধিনায়ক বেদী । সেই ম্যাচে আম্পায়ার ছিলেন খিজর হায়াত ও জাভেদ আখতার । পাকিস্তানের অধিনায়ক ছিলেন মুস্তাক মোহাম্মদ ও বোলার সরফরাজ নওয়াজ । এঁদের পরিকল্পিত অন্যায়ের প্রতিবাদে দল তুলে নেন বেদী ।

বিশ্বজুড়ে পেস বোলারদের একচ্ছত্র দাপটের যুগে স্পিন শিল্পকে এনে একঘেয়েমি দূর করে ক্রিকেটকে আরও সুন্দর ও বৈচিত্র্যময় করে তোলার অন্যতম প্রধান কারিগর ছিলেন বিষান বেদী । তাঁর ফ্লাইটের বৈচিত্র ছিল নজরকাড়া । একই ওভারে ছয় রকমের ছ’টি বল করার ক্ষমতা ছিল এই স্পিনারের । মাত্র কয়েক পা ছুটে এসে আঙুল ও কব্জির মোচড়ে হাওয়ায় বল ভাসিয়ে বিভ্রান্ত করতেন ব্যাটসম্যানদের । বল ডেলিভারির একেবারে শেষ মুহূর্তে বলের গতিপথে বদল ঘটানোর বিরল দক্ষতা ছিল স্পিনের এই মহাশিল্পীর । বলের ওপর নিয়ন্ত্রণ ছিল অসামান্য । সারাদিন বল করেও ক্লান্ত হতেন না ক্রিকেট সাধক বেদী । তাঁর ছন্দোময় বোলিং ছিল দর্শকদের চোখের আরাম ও মনের আনন্দ ।

শচীনের খেলা দেখে প্রাণিত হয়েছেন বিরাট । বিরাটের খেলা দেখে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন শুভমন গিল । গাভাস্কারের খেলা দেখে বড়ো হয়েছেন শচীন । কিন্তু বিষান সিং বেদী কাকে দেখে প্রাণিত হয়েছিলেন ? তেমন কোনো ‘কান্তিময় আলো’ তিনি পেয়েছিলেন কি ? তাঁর ‘ব্রক্ষ্মাস্ত্র ‘ আর্ম বল তিনি কার কাছে শিখেছিলেন ? অন্ধকারে একলা চলতে চলতে নিজের পথ সম্ভবত নিজেই খুঁজে নিয়েছিলেন বিষান বেদী । ক্রমাগত রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত হতে হতে ঘনঘোর অন্ধকারে স্বয়ং হয়ে উঠেছিলেন ‘ কান্তিময় আলো ‘ ।

আরও পড়ুন- বাড়িতেই কোজাগরী লক্ষ্মীর আরাধনা রাজ্যের হেভিওয়েট নেতা-মন্ত্রীদের