
প্রতিদিন আমাদের নুন আনতে পান্তা ফুরোয় । কিন্তু বিশ্বাস করুন , আমরা বছরভর অপেক্ষা করে থাকি দুর্গাপূজার জন্য । আমরা ঢাক বাজাই । ঢাকে কাঠি না পড়লে তো মায়ের পূজা শুরু হয় না । শহরের বাবুরা আসেন পুজোর মাস কয়েক আগে বায়নার টাকা নিয়ে । বহুকাল আগে চারজনে সাকুল্যে পেতাম ৮০০ টাকা । এখন সব জিনিসের দাম বেড়েছে । এখন চারজনে পাই হাজার বিশেক । আর পূজার শেষে এলাকায় বাড়ি বাড়ি ঘুরে আরও হাজার বিশেক । আমরা বংশপরম্পরায় ঢাকী ।
আমি নারায়ণ , আমার বাবা মহাদেব , ছেলে হরনাথ আর ভাগ্নে দিবাকর , এই আমাদের দল । আজ্ঞে , আমাদের নিবাস মুথুকবনি গাঁ , বাঁকুড়া জেলায় ।
হারুচাঁদ ও ফটিকচাঁদ থাকেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার কুলতলি লাগোয়া এক গ্রামে । এঁরা পূজায় পদ্মফুল সরবরাহ করেন । সাপের ছোবল খাওয়ার ঝুঁকি নিয়েও এঁরা পদ্ম তোলেন বরাবর । বেশ ভালো রোজগার হয় এই সময়টায় । নারায়ণ , মহাদেব ও ফটিকের মতো আরও অনেক মানুষ সারাবছর চাতকের মতো অপেক্ষা করে থাকেন মায়ের আগমনের জন্য । দেবীপক্ষের সূচনায় এঁদের পকেটে কিছু নগদ অর্থ আসে । পেট শান্ত হয় । টানাটানির সংসারে অশান্তি বিদায় নেয় অন্তত কয়েক দিনের জন্য ।
সর্বজনীন শারদোৎসবের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থান ও রুটিরুজি । বিগত দু’আড়াই বছরের কোভিডকাল কিছুটা থমকে দিয়েছিল পুজোর অর্থনীতিকে । এখন আবার সবকিছু স্বাভাবিক হতেই পুজোকে ঘিরে লেনদেন জমজমাট । পশ্চিম বর্ধমান শিল্পাঞ্চলে জি টি রোড লাগোয়া এক ধাবায় পুজোর পাঁচ দিনে প্রায় এক কোটি টাকার ব্যবসা হয় !
অন্যান্য উৎসবে এমন বিপুল পরিমাণ লেনদেন ভাবাই যায় না ।
প্রতিমা , ফলমূল ও মিষ্টি-সহ পুজোর সমস্ত সামগ্রী , মৃৎশিল্পী , কুমার , ডেকোরেশন , আলো , মাইক্রোফোন , পর্যটন ব্যবসা , স্পন্সরশিপ , খাওয়া দাওয়া , পাবলিকেশন , পুজোকেন্দ্রিক মেলা , খুচরো বিক্রেতা , হোটেল-রেস্তোঁরা ব্যবসা ইত্যাদি ঘিরে যে বিপুল পরিমাণ অর্থের লেনদেন হয় শারদোৎসবে , তা আর কোনো উৎসবের ক্ষেত্রে হওয়া অসম্ভব । দেবীপক্ষের সমাপ্তিতে অর্থাৎ পঞ্চদশ দিনের পূর্ণিমা তিথিতে মা লক্ষ্মীর পূজা আরম্ভের আগেই লক্ষ্মীলাভ হয়ে যায় সকলের । শারদোৎসবের এমনই অর্থনৈতিক মহিমা ।
এই মহোৎসব ঘিরে অসংখ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয় । একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে , পশ্চিমবঙ্গে দুর্গাপূজা ঘিরে সৃজনশীল শিল্প সংক্রান্ত যে অর্থনৈতিক মূল্য অনুমান করা হয়েছে তা ৩২,৩৭৭ কোটি টাকা , যা বিশ্বের অনেক ছোট দেশের অর্থনীতির আকার । মাত্র পাঁচ দিনের এই উৎসবে এই বিপুল পরিমাণ অর্থের আবর্তন সত্যিই বিস্ময়কর ।
অতিমারির চোখরাঙানি স্তিমিত হওয়ার পরেই অন্য একটি সূত্রের সমীক্ষায় দেখা গেছে গতবছর বাংলায় পুজোর অর্থনীতির বহর ৪৫ হাজার কোটি ছাড়িয়েছে , যা অর্থনীতির দিক থেকে ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করে বানিজ্য মহল ।
শারদোৎসবকে কেন্দ্র করেই বাঙালির যাবতীয় স্বপ্ন-সাধ । জীবনযাত্রার প্রতিটি স্তরে এই উৎসব এমনভাবে প্রভাব বিস্তার করে রয়েছে যে তার বহর বা বৃদ্ধির সঠিক হিসেব নিকেষ করে ওঠা বড়োই দুরুহ ব্যাপার । এখন জনগণের চাঁদায় পুজোর দিন ফুরিয়েছে । মুখ ঢেকে যাওয়া বিজ্ঞাপনের এই যুগে সর্বার্থেই বিজ্ঞাপনদাতাদের হাত থেকেই আসে খরচের অধিকাংশ । জামাকাপড়ের দোকান , জুতোর দোকান , প্রসাধন সামগ্রীর দোকান এবং দশকর্মার দোকানগুলোতে পুজোর কয়েক মাস আগে থেকে শুরু করে পুজোর দিনগুলোতে বিক্রিবাটা হয় কয়েক হাজার কোটি টাকার ।
গতবছর,অর্থাৎ ২০২২ সালে পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ৪৩ হাজার পূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে । গত দশ বছরে রাজ্যে দুর্গাপূজার সংখ্যা ৯১ শতাংশ বেড়েছে । শুধু কলকাতায় দুর্গাপূজা হয়েছে প্রায় ২৫ হাজার মণ্ডপে । এর মধ্যে বাড়ির পূজাও রয়েছে । শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয় , ঝাড়খণ্ড , বিহার , উড়িষ্যা , আসাম , ত্রিপুরা , দিল্লি ও মুম্বাই- সহ বিভিন্ন রাজ্যে অসংখ্য দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে প্রতিবছর ।
আনন্দের কথা , অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক ও কর্মীরা বিকশিত হন শারদোৎসবের সমসাময়িক অর্থনীতিতে । যাঁরা প্রতিমা গড়েন , যাঁরা মাটির প্রদীপ বানান , যাঁরা ফুল বিক্রি করেন , যাঁরা মণ্ডপ তৈরি করেন , যাঁরা পূজার সামগ্রী সরবরাহ করেন , তাঁরা সকলেই সারা বছরের উপার্জনের একটা বড়ো অংশ হাতে পান এই সময়েই । পূজা-এলাকায় দোকান দেন যে সমস্ত ছোট ব্যবসায়ী , তাঁরাও এই সময়ে কিছু অতিরিক্ত মুনাফা করার সুযোগ পান ।
আমাদের দেশের অর্থনীতি মূলত আবর্তিত হয় অসংগঠিত ক্ষেত্রের জন্য । এইভাবে দেখতে গেলে পুজোয় সেই অংশের উন্নতির অর্থ এক অর্থে অর্থনীতির সার্বিক উন্নয়ন , যার গুরুত্ব অপরিসীম । অতিমারির সময়ে পুজোকেন্দ্রিক অর্থনীতির সামগ্রিক অবনমন নিয়ে বিশ্লেষণ হয়েছে বারবার । কারণ , একথা সত্য যে , বাঙালির প্রাণের এই উৎসবে , বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ এই উৎসব ঘিরে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য হয় । দুর্গাপূজা ঘিরে আর্থিক সচ্ছলতার খানিকটা সুযোগ যদি পান প্রান্তিক , দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত পরিবারের মানুষজন , তার চেয়ে ভালো আর কি-ই বা হতে পারে !
জনতার ভিড় আর বিভিন্ন পূজা কর্তৃপক্ষের অভিনব সৃজনশীলতা যদি সার্বিকভাবে একটি রাজ্যের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তুলতে পারে তাহলে তাকে বাহবা তো দিতেই হয় । উৎসবের ভিড় যদি বহুজাতিক কোম্পানি , বিজ্ঞাপন সংস্থা থেকে শুরু করে বড়ো-ছোটো ব্যবসায়ী , এমনকি চা , পান , চপ , সিঙাড়া , ঝালমুড়ি ও ঘুগনি বিক্রেতাকে পর্যন্ত আর্থিক সহায়তা দিতে পারে তাহলে তাকে স্বাগত জানাতেই হয় ।
আরও পড়ুন- রাজ্যবাসীকে মহাষ্টমীর শুভেচ্ছা জানালেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়