জাতির লজ্জা শিশুশ্র.ম, উৎপল সিনহার কলম

0
4
উৎপল সিনহা

পালান গেল দালান দিতে
পালান গেল পাঁচ শিকেতে
পালান জলে ভেজায় ইট
পালান ভেজাচ্ছে কংক্রিট ।

পালান শিখলো খেতে বিড়ি
পালান শিখলো জুয়াচুরি
পালান কাজে দেয় না মন
পালান ঝিমোয় সারাক্ষণ ।

পালান ধুঁকছে নাকি জ্বরে ?
পালান রোদ্দুরে কাজ করে ।
পালান পড়লো মাথা ঘুরে
পালান জ্বরেই গেল পুড়ে ।

পালান পায় না পানি হালে
পালান চালান হাসপাতালে
পালান থাকবে কতক্ষণ
পালান যাবে বিসর্জন ।।

মন বিমর্ষ করে দেওয়া এই পালান-কাহিনী মনে পড়িয়ে দেয় আরেক হতভাগ্য পালানের কথা । মৃণাল সেনের ‘ খারিজ ‘ চলচ্চিত্রে যে ছেলেটা বদ্ধ রান্নাঘরে দম আটকে মারা গিয়েছিল । মধ্যবিত্ত বিবেক নৃশংস শীতলতায় উপেক্ষা করেছিল এই মর্মান্তিক ঘটনাটি ।‌ আমাদের দেশে শিশুমৃত্যু চলতেই থাকে । সবাই জানে শিশু-কিশোরদের মজুর খাটতে বাধ্য করা আইনবিরোধী । কিন্তু কে মানছে এসব নিয়ম ! কে-ই বা করবে এই পীড়নের প্রতিকার । দারিদ্র থাকলে দারিদ্রের সুযোগ নেওয়াও থাকবে । চায়ের দোকান থেকে ফুটপাতের খাবারের দোকান , ইটভাটা থেকে পাথরখাদান , সর্বত্রই আমরা দেখতে পাই শিশু-শ্রমিক , যাদের এ বয়সে স্কুলে যাওয়ার কথা । কিন্তু হায় , আমাদের এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে জ্বালানির মতো আছে শিশুর যোগান ।

ভারতীয় সংবিধানের ২৪ অনুচ্ছেদে পরিষ্কার বলা রয়েছে , ১৪ বছরের নিচে কোনও শিশুকে কোনও কারখানা , খনি বা কোনও বিপজ্জনক কাজে নিযুক্ত করা যাবে না । ১৯৮৬ সালে
‘ শিশুশ্রম ‘ ( রোধ ও নিয়ন্ত্রণ ) আইন তৈরি হয় । এই আইন অনুযায়ী, ১৪ বছর বয়স পূর্ণ হয় নি এমন ব্যক্তিদের শিশু বলে চিহ্নিত করা হয়েছে । শিশুশ্রম শিশুর শারীরিক , মানসিক তথা সর্বাঙ্গীন বিকাশের ক্ষেত্রে বিরাট অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় ।

‘ শিশুশ্রম ‘ শব্দটি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা-এর পরামর্শ অনুযায়ী যেভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে তা হলো , এমন কাজ যা শিশুদের ( কিশোর-কিশোরী ) শৈশব , তাদের স্বপ্ন , সম্ভাবনা ও প্রাপ্য মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করে এবং তাদের সর্বাঙ্গীন বিকাশের জন্য ক্ষতিকর । তাদের স্কুলের পড়াশোনা থেকে বঞ্চিত করা , তাদের অকালে বিদ্যালয় ছাড়তে বাধ্য করা এবং তাদের দীর্ঘ কায়িক শ্রমে বাধ্য করার চেষ্টাও এই সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত ।
শিশুদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশে কোনো নেতিবাচক প্রভাব যাতে না পড়ে , কোনোভাবেই শিশুরা যাতে শোষিত ও বঞ্চিত না হয় , এ ব্যাপারে ইউনিসেফ কিছু নিয়মনীতি তৈরি করেছে । কারখানা আইন , ১৯৪৮ , অনুসারে ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুদের কোনো কারখানায় নিয়োগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে ।
খনি আইন , ১৯৫২ , অনুসারে ১৮ বছরের কম বয়সী কাউকে খনির কাজে নিয়োগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে ।
কিশোর বিচার ( যত্ন ও সুরক্ষা আইন ) ২০১৫ অনুসারে , যদি কেউ চাকরির নামে একটি শিশুকে মজুর খাটতে বাধ্য করে , তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ । দারিদ্র , শিক্ষার উচ্চ ব্যয় , সামাজিক নিরাপত্তার অভাব ও প্রাথমিক শিক্ষার অভাব এবং সরকারের উদাসীনতা শিশুশ্রমের প্রধান কয়েকটি কারণ । একথা অনস্বীকার্য যে , দারিদ্র শিশুশ্রমের সবচেয়ে বড় কারণ । বিশ্বের উন্নয়নশীল ও অনুন্নত অংশের গ্রামীণ ও দরিদ্র অংশে শিশুদের সামনে প্রকৃত অর্থবহ কোনো বিকল্প নেই ।

২০১৯ – ২০২১- এর তথ্য অনুযায়ী ভারতের জনসংখ্যার প্রায় ১৬.৪ শতাংশ দারিদ্রসীমার নিচে বাস করেন । দারিদ্রের গড় তীব্রতা ৪২ শতাংশ । গুরুতর দারিদ্রের মধ্যে বাস করেন জনসংখ্যার প্রায় ৪.২ শতাংশ । শতাংশের হিসেবে দারিদ্র কিছুটা কমলেও ২০২০ সালের জনসংখ্যার নিরিখে এখনও গোটা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গরিব মানুষ বাস করে ভারতে । এদেশে ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত দরিদ্র নাবালকের সংখ্যা বিশ্বের ২১ শতাংশ । শহরের জনসংখ্যার ৫.৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করেন । গ্রামে সেই হার ২১.২ শতাংশ । গৃহস্থালির কাজ , ইটভাটা ও পাথর ভাঙার কাজ , চায়ের দোকান , হোটেল ও রেস্তোরাঁর শ্রমসাধ্য কাজ , হকারি , রাস্তায় খাবারের দোকানে উদয়াস্ত কাজ , বাজি তৈরির কারখানায় বিপজ্জনক কাজ , কুলিমজুরের হাড়ভাঙা খাটুনির কাজ , অন্ধকার জগতের মাদক পাচারের কাজ ছাড়াও বহু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ব্যবহার করা হয় এইসব হতভাগ্য শিশুদের ।

শৈশবেই তাদের সম্ভাবনাময় জীবনগুলো নষ্ট হয়ে যায় । জীবনের এই মর্মান্তিক অপচয় চলতেই থাকে ।
দারিদ্র , নিরক্ষরতা ও জনসংখ্যা বৃদ্ধি ক্রমাগত শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ । শিশুশ্রম রোধে দেশের সরকারের পরিকল্পনাগুলি আশানুরূপ সাফল্য অর্জনে প্রায়শই ব্যর্থ হয় । এ ব্যাপারে সরকারী পরিসংখ্যান ও রিপোর্টের সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না । আমাদের দেশে বাধ্যতামূলক শিক্ষার আইন কিছুটা কার্যকরী হলেও শিশুশ্রমিক প্রতিরোধ আইন সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে । এর প্রধান কারণ সরকারী উদাসীনতা । সরকারের শিক্ষা পরিকল্পনাগুলিও কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জনে প্রায়শই ব্যর্থ হয় । আজও যারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয় তাদের মধ্যে ৫০ শতাংশ শিশু আমাদের দেশে প্রাথমিক শিক্ষার গণ্ডি পার হতে পারে না । উল্লেখ্য , এখানে কিন্তু অভিভাবকদের মানসিকতাও অনেকটা দায়ী । যে সমস্ত পরিবারগুলোতে মাথাপিছু গড় আয় কম , সেই সমস্ত পরিবারের অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের পড়াশোনা ছেড়ে কোনো কাজে নিযুক্ত হওয়াকেই বেশি লাভজনক মনে করেন । শিশুশ্রমিক সমস্যা দূর করতে সরকারী নীতি ও প্রকল্পগুলির সীমাবদ্ধতা যেমন উল্লেখযোগ্য , ঠিক তেমনই প্রভাবশালী এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী ও দুষ্টচক্র সর্বদা নিজেদের ঘৃণ্য স্বার্থে শিশুশ্রমের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে সক্রিয় থাকে । তারা প্রশাসন ও বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অশুভ আঁতাত তৈরি করে দরিদ্র শিশুদের অন্ধকার জীবন থেকে নিস্তার দেয় না ।

তবে হ্যঁ , আশার কথা এই যে , এই বিপুল অন্ধকারের মধ্যেও আলোর দিশারী হয়ে দরিদ্র ও শোষিত শিশুদের কল্যাণে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে কয়েকটি এন জি ও । আমাদের রাজ্যেও বেশ কয়েকটি এন জি ও এ ব্যাপারে দারুণ সক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে ।

ভারতে শিশুশ্রমিক সমস্যাটি আর্থ-সামাজিক পরিকাঠামোর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত । চাই অবিলম্বে দারিদ্র দূরীকরণের ব্যবস্থা , শিক্ষার বিস্তার ও সামগ্রিক সচেতনতা । ১২ জুন বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস পালিত হয় সারা বিশ্বে । এ বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাওয়ার যে দৃঢ় অঙ্গীকার নবজাতকের কাছে করে গেছেন কবি , তা কি শুধুমাত্র কবিতার লাইন হিসেবেই শোভা পাবে পাঠ্যপুস্তকে ? কবে জাগবে সরকার বাহাদুর ? কবে জাগবে বিদ্বজ্জনশোভিত সমাজ ? কবে সচেতন হবে সংবেদনশীল জনগণ ? কচিকাঁচারা আর কতকাল ভাঙবে পাথর বড়োদের জন্য ? তাদের স্বপ্ন দেখার বয়স পার হয়ে যাচ্ছে যে !

আরও পড়ুন- বাংলার বকেয়া আদায়ে অভিষেকের ল.ড়াইয়ে সামিল ‘বাংলা অধিকার রক্ষা মঞ্চ’