সোমনাথ বিশ্বাস: ‘যাদবপুর মাঙ্গে আজাদী…’! যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতির প্রেক্ষাপটে ক্যাম্পাসের এই স্লোগান খুব পরিচিত। কিন্তু এই স্লোগানের আড়ালে লুকিয়ে থাকা এক ‘কালেক্টিভ’ গ্রুপের বিরাট ষড়যন্ত্র ক্রমশ সামনে উঠে আসছে। কারণে-অকারণে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করাই যাদের এক ও একমাত্র লক্ষ্য। এরা মূল স্রোতের কোনও রাজনৈতিক দলের শাখা নয়। স্বঘোষিত নকশালের নামে খোলসের আড়ালে আসলে চক্রান্তকারী। যাঁরা দিনের পর দিন বহুরূপী হয়ে শিক্ষাঙ্গনে স্বাধীনতার নামে স্বেচ্ছাচারিতার এক ‘কালেক্টিভ’ মুক্তাঞ্চল তৈরি করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
এদের কাছে স্বাধীনতার অর্থ মদ, গাঁজা, মাদক। সঙ্গে উদ্দাম যৌনতা। ক্যাম্পাসে ঘুরপাক খেলেই ছবিটা আরও স্পষ্ট হবে। বিস্তারিত আলোচনার আগে বিধিবদ্ধ ভাবে বলে রাখা দরকার, এই প্রতিবেদন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে নয়। যাদবপুরের মেধাকে সকলেই কুর্নিশ করি। তাই গর্বের যাদবপুর যাতে কলঙ্কিত না হয়, সেই সতর্ক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই একটি ‘কালেক্টিভ’ গ্রুপের মুখোশ খোলাই প্রতিবেদকের উদ্দেশ্য। সেইসঙ্গে মনে রাখতে হবে, যাদবপুর অন্য গ্রহের কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়। ফলে দেশের আইন-শৃঙ্খলা, সংবিধান, সংস্কৃতির ঊর্ধেও নয়। তাই কোনও ‘কালেক্টিভ’ গ্রুপের দিনের পর দিন স্বাধীনতার নামে স্বেচ্ছাচারিতাও বরদাস্ত নয়।
এবার চলে আসুন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপেন এয়ার থিয়েটার বা ওএটি-তে। যেখানে পড়ুয়ারা মন খুলে আড্ডা দেবে। শিক্ষামূলক আলোচনা, বিতর্ক হবে। স্বাধীনভাবে সকলে মতামত প্রকাশের সুযোগ পাবে। কিন্তু ক্যাম্পাসে ‘যাদবপুর মাঙ্গে আজাদী’ স্লোগান দিয়ে শয়ে শয়ে মদের বোতল পড়ে থাকবে, কোথাও আবার কন্ডোমের সঙ্গে গর্ভ নিরোধক বড়ির প্যাকেট ছড়িয়ে থাকবে, সেটা হতে পারে না। কোনও বিশ্ব বিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস কোনওদিন প্রাইভেট প্লেস হতে পারে না। শিষ্টাচারের জায়গায় স্বেচ্ছাচারিতার, আশালীনতাকে প্রশ্রয় দেওয়া যায় না। মুষ্টিমেয় কিছু ছাত্রছাত্রীর স্বেচ্ছাচারিতাকে আড়াল করতে সিসিটিভির উপর নিষেধাজ্ঞা ‘কালেক্টিভ’-দের আজাদীর প্রথম ধাপ।
সাম্প্রতিক অতীতে ঘটে যাওয়া যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের এক ছাত্রের মর্মান্তিক পরিণতির পর ‘কালেক্টিভ’-দের নিয়ে জোরদার চর্চা শুরু হয়েছে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়াতেও আলোচনার কেন্দ্রে ‘কালেক্টিভ’। ছাত্রমৃত্যুর ঘটনার পর সম্প্রতি একটি ফেসবুক পোস্টে ‘কালেক্টিভ’-দের খপ্পড় থেকে বেরিয়ে আসা জনৈক এক ছাত্র তাদের মুখোশ খুলেছে। এই প্রতিবেদনে সেই পোস্টের অংশ বিশেষ তুলে ধরার চেষ্টা করব।
‘কালেক্টিভ’ নিয়ে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ওই ছাত্র প্রথমেই মারাত্মক একটি প্রসঙ্গ টেনে এনেছে। সে লিখছে, “স্বাভাবিক ভাবেই মূল ধারার রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে পরিচিত সাধারণ মানুষের মনে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। কালেক্টিভ কারা? এদের অফিস কোথায়? প্রতীক কী? খায় না মাথায় দেয়, ইত্যাদি ইত্যাদি।” ওই ছাত্রের আরও দাবি, সুকৌশলে প্রচারের বাইরেই থাকতে পছন্দ করে এই
কালেক্টভ। এরা সচেতন ভাবে নিজেদের অস্তিত্ব লুকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে কিংবা হয়েছিল এযাবৎ কাল পর্যন্ত। স্বাধীন রাজনীতির মোড়কে প্রচার এবং মূলস্রোতের রাজনৈতিক ধারার আড়ালে থেকে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করে নেওয়াই এই কালেক্টিভের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ‘স্বাধীন’ মঞ্চগুলিতে, বিভিন্ন সামাজিক কিংবা সাংস্কৃতিক আন্দোলনে নিজেদের লোক ঢুকিয়ে সেই মঞ্চের কার্যকলাপ এবং আন্দোলনকে নিজেদের অঙ্গুলিহেলনে চালানো কালেক্টিভের আধদামড়া মাথারা এই কাজে নিপুণ পারদর্শীতা রপ্ত করেছেন। কিন্তু আড়ালে থেকেও আন্দোলনের রাশ হাতে রাখার চেষ্টা করে কালেক্টিভ।
কিন্তু আড়ালে থেকেও কীভাবে কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে কালেক্টিভদের এমন দাপট? কীভাবে তারা সদস্য বাড়িয়ে ক্যাম্পাসকে মুক্তাঞ্চলে পরিণত করে? এমন সব প্রশ্নের উত্তরও লুকিয়ে আছে ওই ছাত্রেও পোস্টে। ওই ছাত্রের দাবি,
“প্রেসিডেন্সি এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষের কোনও ছাত্র ঢুকলে তাদের কানে বাজবে এই মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত দাদাদের বাণী, ক্যাম্পাসে দলীয় বা ঝাণ্ডার রাজনীতি করিনা আমরা। আমরা একটা স্বাধীন আলোচনার মঞ্চ যেখানে সব মতকে সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়। আমাদের কোনও মাদার পার্টি নেই। আমরা স্বাধীন। এখানে কোনও মেম্বারশিপ নেই। সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্র ছাত্রীদের উপস্থিতিতে জিবি মিটিং (General Body) এর মাধ্যমে।” প্রথম বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই যারা দলীয় রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে চায়, তারা এদের কথায় ভুলে এই মঞ্চে যোগদান করে। তারপর শুরু হয় মগজ ধোলাই।”
ছাত্রটি বলছে, এখানে আসলে GB-এর নামে চলে খাপ পঞ্চায়েত। একনায়কতন্ত্র। এই মঞ্চের টিকি বাঁধা আছে কোনো এক অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির কাছে। সেই ব্যক্তির কাছে পৌঁছনোর কোনও সরাসরি রাস্তা নেই। GB-তে সবসময় কথা বলতে ওঠে দুই থেকে তিনজন। বাকিদের কাজ শুধু হ্যাঁ তে হ্যাঁ, না তে না মেলানো… বুঝে নিতে হবে এরাই কালেক্টিভ। আসলে আসলে স্বাধীনতার সবচেয়ে বড় প্রহসন। যাদবপুর মাঙ্গে আজাদী স্লোগানের মধ্যে দিয়ে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের এরাই সবচেয়ে বেশি পরাধীন করে রেখেছে।
কিন্তু কোনও এক অদ্ভুত সুরক্ষাকবচে বলিয়ান হয়ে এরা বিরোধী মতাদর্শের ছাত্রছাত্রীদের দিকে ছুঁড়েছে কদর্য হুমকি, কখনও তাদের জীবননাশের হুমকি দিতেও দ্বিধাবোধ করেনি। যার ফেসবুক পোস্টের উপর দাঁড়িয়ে এই প্রতিবেদন, জনৈক ওই ছাত্রও ভুক্তভোগী। ওই ছাত্রের জোরালো দাবি, যাদবপুরের হোস্টেলে এই কালেক্টিভের ঘুঘুর বাসাই প্রথম বর্ষের মৃত্যুর জন্য দায়ী। ভিতরে লুকিয়ে বসে থাকা বড়ো বড়ো রাঘববোয়ালদের শনাক্ত করে গ্রেফতার করা সময়ের দাবী। ‘যাদবপুর মাঙ্গে আজাদী’ বাজার গরম করা স্লোগানের আড়ালে আসলে শিক্ষাঙ্গনে স্বাধীনতার নামে স্বেচ্ছাচারিতার এক ‘কালেক্টিভ’ মুক্তাঞ্চল। এই ‘কালেক্টিভ’ গ্রুপের পরাধীনতার নাগপাশ থেকে যাদবপুর মুক্ত হলেই প্রকৃত অর্থে স্বাধীনতা মিলবে সাধারণ পড়ুয়াদের।