
‘ চুম্বন ব্যাপারটাই এক অমর ঘটনা । পর্যটকের মতো এটা ঘুরতে থাকে মানুষের ঠোঁট থেকে ঠোঁটে , এক শতবর্ষ থেকে আরেক শতবর্ষে , অনতিগম্য সময়কাল ধরে । নারী এবং পুরুষ উভয়েই এই চুম্বনকে অর্জন করে , তারপর একে অপরকে সেটি প্রদান করে , তারপরে পালা করে মারা যায় । ‘
( গী দ্য মোপাসাঁ ) তার মানে , পুড়ে যায় এ জীবন নশ্বর , কিন্তু চুম্বন অবিনশ্বর । তাহলে কি অবিনশ্বর হবার বাসনা নেই মানুষের ? নেই আবার ! একশো শতাংশ আছে । মানুষ তো আদিকাল থেকেই অমরত্ব সন্ধানী । চিরঞ্জীব হওয়ার আকাঙ্খা আছে বলেই তো যুগে যুগে বিশ্বের দেশে দেশে এ নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর গবেষণার বিরাম নেই । আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ এখনও হাতে আসে নি বটে , তবে আশার আলো দেখাচ্ছে এক বিশেষ প্রজাতির জেলিফিশ ।
‘ কখনও মৃত্যু হবে না ! সে কেমন জীবন হবে ? ‘ অবশ্য সম্পূর্ণ অমর এখনই বলা যাচ্ছে না জেলিফিশের এই বিশেষ প্রজাতিকে । বলা হচ্ছে , ‘ প্রায় অমর ‘ । ব্যাকওয়ার্ড এজিং জেলিফিশ । প্রাণীবিদদের কাছে যার পরিচয় (turritopsis dohrnii ) টারিটোপসিস ডোরনি । একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের জন্য জেলিফিশের এই ক্ষুদ্র প্রজাতিকে ‘ অমর জেলিফিশ ‘ নামে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে । কিন্তু কীভাবে এরা নিজেদের ‘ প্রায় অমর ‘ করে রেখেছে ? এর উত্তরে বলতে হয় , মৃত্যুর কোনোরকম আশঙ্কা থাকলেই এরা বার্ধক্যের উল্টো পথ ধরে । ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের গবেষকরা জানিয়েছেন , যদি এই জেলিফিশের শরীরের কোনোও অংশে আঘাত লাগে বা অসুস্থতা আসে , তাহলে সঙ্গে সঙ্গে এরা ‘ পলিপ দশা ‘ – য় চলে যায় । চারপাশে মিউকাস মেমব্রেন তৈরি করে গুটি বাঁধে পলিপের আকারে । এই পলিপ অবস্থায় এরা তিন দিন পর্যন্ত থাকে । আর এভাবেই কমিয়ে দেয় বয়স । এই সময়টুকুর মধ্যে শরীরের সব কোষকে নতুন কোষে রূপান্তরিত করে এই জেলিফিশ এবং বয়স একেবারে কমিয়ে ফেলে । এভাবেই বারবার রূপান্তর ঘটিয়ে এরা বার্ধক্যকে ঠেকিয়ে রাখে । যদিও এদের ‘ অমর ‘ বলার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীদের মধ্যে দ্বিমত আছে । কোষের রূপান্তরের মাধ্যমে বয়স পিছিয়ে দেওয়াকে কি ‘ অমর ‘ বলা যায় ? রয়ে গেছে প্রশ্ন । তা সত্ত্বেও গবেষণা চলছে নিরন্তর । কোষের রূপান্তরের মাধ্যমে মানুষের বার্ধক্যকে ঠেকিয়ে রাখা যায় কিনা তা নিয়ে বিশ্বজুড়ে পরীক্ষা- নিরীক্ষার বিরাম নেই । চলছে মানবজাতির অমরত্বের সন্ধান । ভরসা জোগাচ্ছে জেলিফিশ । জেলিফিশ এক ধরনের অমেরুদণ্ডী প্রাণী , যাদের পৃথিবীর সব মহাসাগরে দেখা যায় । নামে ‘ ফিশ ‘ হলেও এটি মাছ নয় , এদের মেরুদণ্ড নেই । প্রায় পাঁচ হাজার কোটি বছর ধরে সমুদ্রে এদের বাস ।
ঘণ্টাকৃতি জেলীসদৃশ এই প্রাণীর দেহ গঠিত জেলিটিন সমৃদ্ধ ছাতার মতো অংশ এবং ঝুলে পড়া কর্ষিকা নিয়ে । কর্ষিকায় থাকে মারাত্মক বিষ , যা প্রাণঘাতী ।জেলিফিশের বৈজ্ঞানিক নাম Aurelia Aurita , অরেলিয়া অরিতা । এরা সমুদ্রে স্রোতের টানে ভেসে বেড়ায় । ভাটার সময় বেলাভূমিতে থাকে । জেলির মতো নরম থলথলে এবং অর্ধস্বচ্ছ ছত্রাকৃতি দেহ নিয়ে সমুদ্রে এদের অবাধ বিচরণ ।
ফেরা যাক জৈবিকভাবে অমর জেলিফিশে । এদের দেখা মেলে ভূমধ্যসাগর এবং জাপান এলাকায় । এটিই এখনও পর্যন্ত একমাত্র প্রাণীর উদাহরণ যা যৌন পূর্ণতাপ্রাপ্তির পর নিজেকে সম্পূর্ণরূপে একটি যৌন অপূর্ণাঙ্গ ঔপনিবেশিক পর্যায়ে রূপান্তরিত করার ক্ষমতা রাখে । টারিটোপসিস ডোরনি প্রজাতির জেলিফিশের জিন বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা দাবি করেছেন , এর সাহায্যে মানুষেরও অমরত্বপ্রাপ্তির পথের সন্ধান মিলতে পারে । রোগে ভুগে এই বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী জেলিফিশের মৃত্যু হতেই পারে , তবে প্রাপ্তবয়স্ক জীবন থেকে লার্ভা পর্যায়ে ফিরে যাবার ক্ষমতা রয়েছে এদের , যার ফলে বার্ধক্যকে বিপরীতমুখী করে যতদিন চায় ততদিন বেঁচে থাকতে পারে এরা । প্রসিডিংস অফ দ্য ন্যাশনাল আকাদেমি অফ সায়েন্সেস-এ প্রকাশিত হয়েছে এই গুরুত্বপূর্ণ সমীক্ষা । তথাকথিত ‘ অমর ‘ জেলিফিশের জিনোম সিকোয়েন্স এবং ডি এন এ- র
সঠিক অংশটিকে বিচ্ছিন্ন করতে সক্ষম হন বিজ্ঞানীরা , যেটি আসলে একটি বৃদ্ধ জেলিফিশ । গবেষণার জন্য নির্দিষ্ট ডি এন এ খণ্ডগুলি বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল। এটি আবার মেটাজোয়ান নামেও পরিচিত , যারা নিজেদের একটি অতি ক্ষুদ্র সংস্করণে রূপান্তরিত করার কাজে ব্যবহৃত হতে পারে । বারবার নিজেদের পুনরুজ্জীবিত করতে পারে বলেই জেলিফিশের এই বিশেষ প্রজাতি জৈবিক অমরত্বের ইঙ্গিত দেয় এবং বার্ধক্য সম্পর্কে আমাদের প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে । বিজ্ঞানীদের একাংশের দাবি , আজ থেকে বহু দশক পরে সম্ভবত মানুষের বার্ধক্যকে বিপরীতমুখী করার পথ দেখাতে পারে জেলিফিশ নিয়ে এই গবেষণা এবং এমন অনেক রোগ নিরাময় করতে পারে যা এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে কল্পনা করাও অসম্ভব । তাহলে আসুন , অমরত্বপ্রাপ্তির প্রস্তুতিপর্বে সমবেত কণ্ঠে জীবনের জয়গানে আরেকবার সোচ্চার হই ।
আরও পড়ুন- মণিপুর ইস্যুতে রাষ্ট্রপতিকে চিঠি দিচ্ছেন পুজোর মহিলা উদ্যোক্তারা, নেতৃত্বে চন্দ্রিমা