‘পাখিদের চরাচর’, উৎপল সিনহার কলম

0
1
উৎপল সিনহা

‘একদিন পৃথিবীতে মানুষ থাকবে না । থাকবে শুধু পাখি । চরাচর জুড়ে শুধু পাখি আর পাখি । মানুষের এত লোভ! ‘এই ধরনের সংলাপ আছে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ‘ চরাচর ‘ চলচ্চিত্রে । প্রফুল্ল রায়ের একটি উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত এই ছায়াছবির মুখ্য চরিত্র এক ‘ পাখিধরা ‘ , যিনি একদিন পাখিদের যন্ত্রণা উপলব্ধি করবেন এবং শেষে খাঁচা খুলে সব পাখি উড়িয়ে দেবেন অনন্ত আকাশে । মুক্তি পাওয়া বন্দী পাখিরা হঠাৎ পাওয়া স্বাধীনতায় কিছুটা বিস্মিত ও বিহ্বল হয়ে ধীরে ধীরে ডানা মেলে উড়ে যেতে থাকবে দূর থেকে আরও দূরে । পাখিধরার মুখের হাসিতে লেগে থাকবে আশ্চর্য এক প্রশান্তি । চোখে একরাশ আলো । তারও বুক থেকে এক পাষানভার নেমে গেল যে ! সেও তো পাখিদের মতোই মুক্ত-স্বাধীন হলো বহু যুগের শেষে ।
মানুষে মানুষে ছয়লাপ এই চরাচরে আজ পাখিরা শুধু যে কোনঠাসা তা-ই নয় , ভয়ঙ্কর বিপন্ন । তবুও তাদের রয়েছে নিজস্ব বাসভূমি । সে এক অদ্ভুত জগত । পাখিদের পৃথিবী । এই পৃথিবীতে , এই বিশ্বপ্রকৃতিতে তাদের অধিকার যুগ-যুগান্তরের ।

বলা হয় , পাখিদের উদ্ভব ঘটেছে ১৫০ মিলিয়ন বছর আগে জুরাসিক পিরিয়ডে । অরনিথিশ্চিয়ান ডাইনোসর
টেরোসর থেকে পাখির উৎপত্তি ঘটেছে বলে মনে করা হয় । তবে আধুনিক পাখিরা ক্রিটেসিয়াস পিরিয়ডে উদ্ভূত বলে জানা যায় । প্রাণীবিদ হাক্সলে সরীসৃপ থেকে পাখিদের উদ্ভব হয়েছে বলে ‘ birds are glorified reptile ‘ বলে অভিহিত করেছেন । নির্বিচারে ঝোপঝাড় তথা অরণ্যনিধন , প্রযুক্তির বিপুল বাড়বাড়ন্ত আর আধুনিক নগরায়নের সাঁড়াশি আক্রমণে পাখিরা আজ সন্ত্রস্ত ও বিপন্ন । তাদের আদি বাসভূমি থেকে তারা নির্বাসিত আজ । ঘুলঘুলি থেকে উধাও হয়েছে চড়ুইয়ের দল । ঝিলের ধারে ঝাঁক ঝাঁক পরিযায়ী পাখিদের আনন্দকল্লোল স্তব্ধ হয়েছে বহুকাল আগেই ।

বহুযুগ আগে যখন পৃথিবীর বুকে ঘুরে বেড়াতো বিশালাকার ডাইনোসর , সেই সময় থেরোপোডা ডাইনোসরদের একটি ক্ল্যাড প্যারাডিস থেকে পক্ষীকুলের উৎপত্তি হয়েছিল । এই পক্ষীকুল বায়োলজিক্যালি এভিস শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত । প্রায় এক শতাব্দী আগে পৃথিবীর বুকে আবিষ্কৃত হয়েছিল এক অদ্ভুত প্রাণীর জীবাশ্ম । সে ছিল না পাখি না ডাইনোসর । সেই অদ্ভুত পাখিটির নাম ছিল আরকিওপটেরিক্স । বর্তমানে বহু পক্ষীবিজ্ঞানী আজও এই পাখিটিকেই পক্ষীকুলের শুরু বলে মনে করেন । এই পাখির জীবাশ্ম জানান দিয়েছিল কীভাবে ডাইনোসর থেকে পাখির জন্ম হয়েছিল । পাখিটির নামের অর্থ হলো ‘ ওল্ড উইং ‘ , অর্থাৎ পুরোনো ডানা । ছোট্ট সাইজের পাখিটি ছিল লম্বায় মাত্র ০.৫ সেন্টিমিটার , কিন্তু তার ছিল বিশাল বড় ডানা ।
ছিল দাঁতযুক্ত চোয়াল ও নখযুক্ত আঙুল এবং এরসাথে ছিল একটা লম্বা হাড়যুক্ত লেজ , যা ছিল ডাইনোসরের স্বরূপ । এই পাখিটি ছিল নন-এভিয়ান ডাইনোসর এবং পাখির মধ্যবর্তী একটি স্টেজ । কিছু পতঙ্গ ও বাদুড়ের পাখা থাকলেও কেবল পাখিদেরই পালক রয়েছে । পৃথিবীতে পাখির প্রজাতি আছে প্রায় ১০,০০০ টি । বর্গ , গোত্র , গণ এবং প্রজাতিতে পক্ষীকুলকে বিন্যস্ত করা হয়েছে । তবে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন প্রজাতি আবিষ্কৃত হয়ে চলেছে । জীবিত পাখিদের মধ্যে মৌ হামিংবার্ড আকারে সবচেয়ে ছোটো
( ২ ইঞ্চি ) , আর উটপাখি সবচেয়ে বড়ো ( ৯ ফুট ) ।

মানুষের অনেক আগে পৃথিবীতে এসেছে পাখি । সেই হিসেবে পৃথিবীর অধিকার পাখিদের কম তো নয়ই , বরং বেশি । কিন্তু মানুষের সর্বগ্রাসী লোভ পাখিদের প্রতিমুহূর্তে চরম বিপদাপন্ন করে তুলছে । খাদ্য-খাদকের সম্পর্ক ? প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা ? পাখিরা যদি কথা বলতে পারতো তাহলে মানবজাতির কাছে এই প্রশ্ন অবশ্যই রাখতো , ‘ তোমাদের তো চেতনা আছে , তবু রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবকে কেন বলতে হয়েছিল , ‘ তোদের চৈতন্য হোক ‘ ? এই সীমাহীন লোভ নিয়ে কোথায় পৌঁছোতে চাও তোমরা ? তোমাদের লোভে শেষ হয়ে গেছে আমাদের বহু প্রজন্ম । এমনকি ডোডো পাখি , যাদের মতো শান্ত , নিরীহ আদুরে পাখি আর দুটি হয় না , যারা এসেছিলো একবুক বিশ্বাস নিয়ে তোমাদের স্নেহসঙ্গ পেতে , তাদেরও হত্যা করে খেয়ে শেষ করে ফেলেছো তোমরা ? ডোডোরা তো আজ বিলুপ্ত হয়ে গেছে এই বিশ্বসংসার থেকে । তোমাদের একটুও অনুতাপ হয় না ? এত খেয়েও তোমাদের আশ মেটে না কেন মানুষ ? আমাদের এক প্রজাতিকে গিলে ফেলে আরেক প্রজাতির দিকে নৃশংস থাবা বাড়াও তোমরা প্রতিনিয়ত । তোমাদের অন্তহীন খিদে মিটবে কবে কে জানে ! তবে এও জেনো , শেষ পর্যন্ত আমরাই থাকবো পৃথিবীতে । তোমরা থাকবে না । সীমাহীন লোভে ধ্বংস হবে তোমরা । তোমাদের বিলুপ্তি শুধু সময়ের অপেক্ষা । উপকারীর অপকার করে মহাপাতকেরা । তাদের সর্বনাশ অনিবার্য । ‘

আরও পড়ুন- ইংরেজির পাশাপাশি মাতৃভাষায় পঠনপাঠন, নয়া বিজ্ঞপ্তি সিবিএসই বোর্ডের