অভিজিৎ ঘোষ
ভঙ্গিটা সেই চেনা বাঙালি আইকনের। খালি ময়দানটা আলাদা। ওটা ছিল ২২ গজ। এটা রুক্ষ, শুকনো, পিচ্ছিল রাজনীতির ময়দান। ২২ গজের বাঙালি আইকন বলতেন, আন্তর্জাতিকস্তরে খেলতে গেলে দরকার আসলে বুকের খাঁচাটা। আমিও পারি নাছোড় মনোভাবটা লালন করতে হয়। সেই জেদ, সেই পরিকল্পনা, সেই নাছোড় মনোভাব নিয়ে আই ক্যান ডু ইট ভঙ্গিমায় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় (Abhishek Banerjee) জনসংযোগ যাত্রায়। বাপি বাড়ি যা ভঙ্গিতে উড়িয়ে দিচ্ছেন সব সমালোচনার ঝড়, সব কিন্তুর জবাব দিচ্ছেন তৃণমূল কংগ্রেসের (TMC)পতাকা হাতে জনপ্লাবনে ভেসে।
তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্যতম সেরা সৈনিক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। নেত্রী পথ প্রদর্শক। টানা ৩০ বছরে বিরোধী আন্দোলনের আইকন। কখনও অনশন। কখনও টানা ধরনা। কখনও আমলাশোল থেকে আসানসোল, সাগর থেকে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম থেকে নদিয়া। কখনও পায়ে হেঁটে, বাইকের পিছনে, কখনও মিছিলে পা মিলিয়ে, রাইটার্সের অলিন্দে তো কখনও ধর্মতলায়। সেই জারণ ক্ষমতা নিয়ে ময়দানে অভিষেক।
কর্মসূচি ঘোষণার সময় বিরোধীরা ভেবেছিলেন ডাহা ফেল করবেন ৩৫ বছরের যুবক। তাল ঠুকছিলেন। অপেক্ষা করছিলেন। ছিলায় মোম মাখাচ্ছিলেন। তিরটা শুধু যেন ছোঁড়ার অপেক্ষা। টানা দু’মাস? হয় নাকি? সম্ভব নাকি? অবাস্তব। মোমের শরীর সইবে না। লোক হাসাবে। কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ কেন কালিয়াগঞ্জেই ইতি হবে। কিন্তু নবজোয়ারে তৃণমূল কংগ্রেস এগোচ্ছে নেত্রীর নির্দেশে, অভিষেকের নেতৃত্বে। যত দিন এগোচ্ছে দু’পাশে ভিড় বাড়ছে, বাড়ানো হাতের সংখ্যা বাড়ছে, বাঁধ ভাঙা ভালবাসায় দুদিনের নির্দিষ্ট পথ চারদিন লাগছে। সত্যি নবজোয়ার।
নবজোয়ারের প্লাবন ডাকার রহস্যটা কোথায়? অভিষেক হঠকারী নন। রাজনৈতিক কর্মসূচির আগে ছিল দীর্ঘ পরিকল্পনা। সেখানেও পার্টি নেতৃত্ব। সিনিয়র থেকে জুনিয়র, অভিজ্ঞ থেকে তরুণ। সব মিলিয়ে চ্যাম্পিয়ন একটা টিম।
এক, জনসংযোগ। শুধু গাড়ির মাথায় নয়, পায়ে হেঁটে, মিছিলে। সঙ্গে নেতৃত্ব নয়, তৃণমূলের তৃণমূল স্তরের কর্মীরা। রাস্তার দুধারে মানুষের কাছে যাওয়া, হাতে হাত মেলানো, মায়ের কোলে থাকা শিশুকে কোলে তুলে নেওয়া কিংবা ১২৭ বছরের বৃদ্ধা শুধু তাঁর জন্য দাঁড়িয়ে আছেন দেখে থেমে যাওয়া, কথা বলা, কুশল জিজ্ঞাসা করা, বার্ধক্যভাতা পাচ্ছেন কিনা জানতে চাওয়া, প্রণাম করা আর প্রাণ ভরা আশীর্বাদ নিয়ে ফিরে যাওয়া। আটপৌড়ে গৃহবধূকে বলতে শোনা গিয়েছে, ওকে দেখার ইচ্ছে ছিল। শুধু দেখলাম না, হাতও মেলালাম। সাধ পূর্ণ। সন্ধে গড়িয়ে রাত। তখনও এগিয়ে চলেছেন অভিষেক। আর গ্রামের আলপথ বেয়ে গৃহবধূরা ছুটেছেন অভিষেককে দেখতে। চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা মুশকিল।মোবাইল যুগের তরুণ-তরুণীরা অভিষেককে দেখতে বাড়ির ছাদের পাঁচিল থেকে শুরু করে শুধু কার্নিসে চড়ে বসেননি, অনেকে সব নিরাপত্তা ভেঙে দিয়ে তরুণ নেতার সঙ্গে সেলফি তুলতে চেয়েছেন। আবদার মিটিয়েছেন অভিষেক।
দুই, সভা। ভাবা গিয়েছিল সভা হবে ছোট ছোট। কিন্তু আঁখো দেখা হাল বলছে, লোকসভা ভোটের সভার সমান ভিড়। খোলা মঞ্চ, কিন্তু মাথা ঢাকা। কর্মী, সমর্থক, আমজনতাকেও সমান গুরুত্ব, মর্যাদা। অভিনব।
তিন, রাতে অধিবেশন। সেখানে দল কী চায়, কেমনভাবে চলতে চায়, কাদের নিয়ে চলতে চায়, লক্ষ্য কী, লড়াই কোথায়, বিরোধীদের নোংরা রাজনীতি কোথায়, তা বিশ্লেষণ করেছেন। যারা ভাবতেন সংগঠন নিয়ে ভাবনা তরুণ নেতার পরিস্কার নয়, তারা বুঝলেন, শুধু পরিস্কার নয়, স্বচ্ছ্ব ভাবনা।
চার, রাতে ভোট। বাংলার রাজনীতিতে এ এক বিস্ময়কর পদক্ষেপ। প্রার্থী কে, তা ঠিক করবেন কর্মী, সমর্থক, আমজনতা! এটা কারওর ভাবনাতেই আসেনি। আর এর জন্য ভোট? এতে একদিকে কে কাকে চাইছেন পরিস্কার। আবার দলের ভাবনা মিলছে কিনা সেটাও স্পষ্ট হবে। আর এই দুই ভাবনার মেলবন্ধনই তো করতে চান সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। এখানে প্রথম দিকে কেউ কেউ কিছু বিতর্কিত পরিস্থিতি তৈরি করতে চেয়েছেন। অভিষেক রোগটা বুঝে কড়া দাওয়াই দিয়েছেন পরের দিন থেকেই। তারপর থেকে এক শ্রেণির মিডিয়ার তৈরি করা উত্তেজনা কোথায়!
পাঁচ, কখনও প্রয়োজনে আক্রান্তের বাড়ি চলে গিয়েছেন। কখনও দাওয়ায় বসে গ্রামের পরিবার, পরিজনদের সঙ্গে কথা বলেছেন। দণ্ডিকাণ্ডে অপমানিত মহিলাদের সঙ্গে বসে ভাঁড়ে চা খেয়েছেন। আশ্বাস দেওয়া নয়, দলের অপরাধী নেত্রীর বিরুদ্ধে ১৮ ঘন্টার মধ্যে ব্যবস্থা নিয়েছেন। রাফ অ্যাণ্ড টাফ। রেয়াত নয় স্পষ্ট বার্তা। আবার অনেক আগের প্রতিশ্রুতি মনে রেখেছেন। গৃহশিক্ষকের বাড়ির মাটিতে আসন পেতে ভাত দিয়ে বোরোলি মাছের ঝোল খেয়েছেন। গোটা বাংলা দেখেছে। পুজো দিয়েছেন, মসজিদে গিয়েছে, আদিবাসীদের পাশে দাঁড়িয়ে বিরোধীদের চক্রান্তের জাল ছিঁড়ে ফেলেছেন।
ছয়, টানা দু’মাসের কর্মসূচি। হেকটিক, বৈচিত্র্যপূর্ণ, রাজনৈতিকভাবে রিস্কি পথ দিয়েই অভিষেক হাঁটছেন। যে পথ দিয়ে এ যাবৎকালের কেউ হাঁটার সাহস করেননি। দলনেত্রী তো পরিস্কার বলেছেন, ওরা আজকের প্রজন্ম। জেদ আছে, করে দেখানোর ইচ্ছা আছে, চ্যালেঞ্জ নিতে জানে।
এবং সাত, চাইলে হোটেলে, সরকারি অতিথিশালায় থাকতে পারতেন। কিন্তু অভিষেক অন্যদের সঙ্গে মাঠেই থাকছেন। গভীর রাত অবধি মিটিং। তারপর রিভিউ। কোথায় ভুল হল? কোথায় আর একটু বেশি সময় দিতে হবে তার পরামর্শ। পরদিনের কর্মসূচি তৈরি। বাকিদের বুঝিয়ে দেওয়া। মাঠে নেমে প্রতিদিন সামনে থেকে লিড। লিডার।
নিট রেজাল্ট কী? সলিলের ওই গানের কথাটার মতো… জবাব পাবে কি তার কাছে। বিরোধীরা বেবাক। কেউ বললেন বাচ্ছা ছেলে। কেউ বললেন কোথা থেকে এই টাকা আসছে? কেউ বললেন, মানুষ কোথায়? দিনাজপুর থেকে মুর্শিদাবাদ, জনপ্লাবন। অভিষেক বোধহয় আপন মনেই বলছেন… মেরা পাস জনতা জনার্দন হ্যায়, বাকি সব তুম লোগ লেকর যাও। ভয়টা এতটাই প্রবল যে বিজেপির ঘোষণা, মণ্ডলে তারা ১০০০টি সভা করবে। সিপিএম বলছে, তারা তৃণমূল স্তরে সই সংগ্রহে নামবে। কংগ্রেস এখনও ভেবে উঠতেই পারেনি। কারা যেন মিটিমিটি হাসছে।
অভিষেকের এই বাপি বাড়ি যা ভঙ্গিতে ব্যাটিং রাজনীতির ময়দানে নতুন, অবাক করা, চ্যালেঞ্জের। জবাব দেওয়ার রাজনৈতিক হিম্মত আছে এই বিরোধীদের? দেখে তো মনে হচ্ছে সুকান্ত-সেলিম-অধীররা স্প্লিলবার্গের থ্রিলার দেখছেন!!