হর মে হর কো দেখা, উৎপল সিনহার কলম

0
1
উৎপল সিনহা

সবার মধ্যে সবাইকে দেখেছি।
প্রত্যেকের মাঝে প্রত্যেককে দেখেছি । একের মধ্যে অন্যকে দেখেছি। অন্যদের মাঝে এককে দেখেছি । সবার মধ্যে ঈশ্বরকে ( শিব ) দেখেছি । ঈশ্বরের মাঝে সবাইকে দেখেছি । প্রত্যেকের মধ্যে দেখেছি ঈশ্বরকে । শিবের মধ্যে জীব দেখেছি এবং জীবের মাঝে শিব । সবার মাঝে প্রত্যেক এবং প্রত্যেকের মাঝে সবাইকে দেখেছি । বিবিধের মাঝে বিবিধ দেখেছি । বিবিধের মাঝে এককে দেখেছি এবং একের মধ্যে বিবিধ । একের মাঝে অনেক দেখেছি এবং অনেকের মাঝে দেখেছি এক ও অভিন্নকে ।

বাচ্যার্থ বেড়েই চলেছে যেন । মাত্র কয়েকটি শব্দে গাঁথা ছোট্ট একটি বাক্যের কী বিশাল ব্যাপ্তি ! সীমাহীন । অফুরান ।
‘ হর মে হর কো দেখা বাবা ‘ একটি হিন্দি চলচ্চিত্রের গান। ছবির নাম ‘ মান্ডি ‘ । নাসিরুদ্দিন ও শাবানা অভিনীত সাড়া জাগানো এই ছবিটি প্রগতিশীল ছবির ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য মাইল ফলক হয়ে আছে । বারবার দেখা যায় ‘ মান্ডি ‘। অসামান্য এই ছবির মূল বার্তা। ছবির পটভূমি দরিদ্র যৌনকর্মীদের একটি বস্তি । যেটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে সরকার । বেঘর হয়ে অগত্যা রাস্তায় আস্তানা গেড়েছে যৌনকর্মীরা । তখনই হচ্ছে এই বিপুল অর্থবহ গানটি । কে না জানে ‘ হর ‘ শব্দের অর্থ । কে না শুনেছেন ‘ হর হর মহাদেব ‘ ? আবার ‘হর ‘ কথাটি কখনো ‘ সবাই ‘ ও কখনো ‘ প্রত্যেক ‘ বোঝাতে ব্যবহৃত হয় । কখনো ‌কখনো একটিমাত্র শব্দ অনেক ‘অর্থ ‘ নিয়ে হাজির হয় ।

সবের মধ্যে এক , আর , একের মধ্যে সব অভেদ বোধের মূলকথা । এ প্রসঙ্গে প্রণবেন্দু দাশগুপ্তের একটি কবিতার কয়েকটি লাইন উল্লেখ করা যায় । কথাগুলি অনেকটা এইরকম : সুতোয় সুতোয় গাঁথা সবার জন্মের নাড়ি , তুমি তা জানো না ব’লে জেগে থাকো , এপাশ ওপাশ করো ।
বড়ো আদরের শমির মৃত্যুর পরদিন ট্রেনে ফিরতে ফিরতে রবীন্দ্রনাথ দেখছেন জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে আকাশ । সবই ঠিক চলছে। কোথাও কিছু কম পড়ে নি । ওনার মনে হলো , ‘ সমস্তের মধ্যে সব রয়ে গেছে আর তার মধ্যে আছি আমিও । ‘

প্রবাসে রবীন্দ্রনাথকে ল্যাটিন শেখাতে আসতেন এক ভদ্রলোক । বড়োই বিমর্ষ থাকতেন ইনি । ভাবুক প্রকৃতির এই মানুষটির গবেষণার বিষয় ছিল , ‘ সমগ্র বিশ্বজুড়ে একটি অখন্ড মন আছে । ‘ এই মানুষটির স্ত্রী ও কন্যা পর্যন্ত তাঁর গবেষণার বিষয়টিকে বিন্দুমাত্র গুরুত্ব দিতেন না , এমনকি তা নিয়ে ঠাট্টা -তামাশাও করতেন । শিক্ষাঅন্তে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে টিউশন-ফি দিতে চাইলে তিনি বলেন , ‘ দেখো রবি , আমার গবেষণা ও জগতের নানা বিষয়ে তোমার সঙ্গে অনেক আলোচনা হয়েছে কিন্তু আমার কাছে ল্যাটিন ভাষা কিছুই তো শেখা হয় নি তোমার । তাই টিউশন ফি আমি নিতে পারবো না । ‘
এরপর রবীন্দ্রনাথ স্বদেশে ফিরেছেন । ভালোখারাপ অনেক ঘটনা ঘটেছে জীবনে । বয়সও বেড়েছে অনেক । কিন্তু কোনদিনই ভুলতে পারেন নি সেই ল্যাটিন শিক্ষকের গবেষণার আশ্চর্য বিষয়টিকে ,কারণ রবীন্দ্রনাথ নিজেও বিশ্বাস করতেন যে বিশ্বজুড়ে একটি অখন্ড মন বিরাজমান ।

আরও পড়ুন- বাংলার প্রাক্তন রাজ্যপালের প্রয়াণে শোকজ্ঞাপন মুখ্যমন্ত্রীর

মোনালিসার স্রষ্টা লিয়োনার্দোর অবিস্মরণীয় চিত্র দ্য লাস্ট সাপার শেষ করতে বহু বছর লেগেছিল । সেখানেও শেষ পর্যন্ত দেখা যায় জিশু ও জুডাস অভিন্ন । একই ব্যক্তি তাঁরা । আসলে লিয়োনার্দোর ছবি , রবি ঠাকুরের অভিজ্ঞতা , প্রণবেন্দু দাশগুপ্তের কবিতা এবং মান্ডি ছায়াছবির গানের বিষয়বস্তু প্রায় এক ও অভিন্ন।
আমরা আগে জেনেছি মানবসভ্যতার আদি ভূমি পূর্ব আফ্রিকার কোন এক অংশে ।

তাই সেই দেশের সঙ্গে একটি আত্মীয়তার বন্ধন অনুভব করে এসেছি । আবার এখন বলা হচ্ছে পূর্ব আফ্রিকা নয় , মানব সভ্যতার আদি ভূমি ইউরোপের কোন দেশ । ইউরোপের কাছেও তো পৃথিবীর ঋণ অশেষ ।
সে যাই হোক , মূল কথা হলো এই মহাবিশ্বে সবাই সবার আত্মীয় । জাত , ধর্ম , বর্ণ , সম্প্রদায় , দেশ ও ভাষার কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে মানবসমাজকে বিচ্ছিন্ন রাখার যতো আয়োজনই থাকুক না কেন , মানুষ শেষপর্যন্ত মানুষের জন্য , জীবন জীবনের জন্য , এই শাশ্বত সত্যকে বৃহত্তর বোধ কখনও অস্বীকার করে না । এটিই মানবসভ্যতার সর্বোত্তম উপলব্ধি ।