
‘ঢাকো রে মুখ চন্দ্রমা, জলদে।
বিহগেরা থামো থামো।
আঁধারে কাঁদো গো তুমি ধরা।।’
কিন্তু এ ঢাকা ঠিক সে ঢাকা নয়। যদিও এও লজ্জা, সেও লজ্জা, তবুও ‘জলদে ‘ ঢাকা অনেক স্বস্তির এবং শেষপর্যন্ত আশাব্যঞ্জক। কিন্তু এখানে কঠোর আদেশ আর ভয়ঙ্কর ফতোয়া। ঢাকোরে মুখ হিজাবে। ঢাকো নয়তো মরো।
সভ্যতার ইতিহাস ঘাঁটলে দেখতে পাওয়া যায় যে কোনো ফতোয়ার আয়ুই অনন্তকাল নয়। বিজ্ঞানের অমোঘ সূত্রও তো অপরিবর্তনীয়। আর তা হলো, প্রতিটি ক্রিয়ারই সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। নিহত মাশা আমিনি এখন সারা পৃথিবীর সর্বোচ্চ বিরোধী স্বর। ‘ ফতোয়া ‘ এখানে উপলক্ষ্য মাত্র। মাশার হিজাবরূপ ফতোয়া বিরোধীতা আসলে সারা বিশ্বের সমস্ত মৌলবাদী জোটের কাছে অশনি সঙ্কেত।
শুধু ধর্মীয় মৌলবাদ নয়, রাজনৈতিক মৌলবাদ-সহ যে কোনো মৌলবাদই সমান ঘৃণ্য।
বাইশ বছরের তরুণী মাশা আমিনির পুলিশ লকআপ-এ মৃত্যু নিয়ে বিক্ষোভের লেলিহান আগুনে পুড়ছে তেহরান, ইরান। কুর্দিস্তানের সাকেজ শহরের মেয়ে মাশা তাঁর ভাই কিয়ারাসের সঙ্গে তেহেরান আসছিলেন। ঠিকমতো হিজাব বা নিকাব না পরার ‘ অপরাধে ‘ মাশাকে আটক করে তেহরানের নীতিপুলিশ। পুলিশি হেফাজতে অসুস্থ হয়ে পড়া তরুণীকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে তিনদিন কোমায় থাকার পর মৃত্যু হয় মাশার। বোঝাই যায় এই মৃত্যু আসলে হত্যা। মাইক্রোবায়োলজি নিয়ে পড়তে চেয়েছিল মাশা, ডাক্তার হতে চেয়েছিল। ওর কোনো স্বপ্ন আর পূরণ হবে না।
পুলিশ লকআপ থেকে সোজা হাসপাতাল এবং তারপর কোমায় চলে যাওয়া মাশার এই মৃত্যু গোটা ইরান জুড়ে মানুষের বিক্ষোভের আগুনে যেন ঘি ঢেলেছে। মধ্যরাতের তেহরানে দেখা যাচ্ছে রাস্তার মাঝখানে আগুন জ্বলছে এবং সে আগুনে নিজেদের হিজাব ছুড়ে দিয়ে প্রাণের আনন্দে নাচছেন তরুণী-যুবতীরা। আর, তা দেখে নারী পুরুষ নির্বিশেষে কয়েক- শো জনতা ফেটে পড়ছেন স্বতস্ফুর্ত উল্লাসে। প্রৌঢ়া নারী চিৎকার করে বলছেন, ‘ স্বৈরাচারীর মৃত্যু হোক। ‘ মধ্যবয়স্কা ভদ্রমহিলা মাথার হিজাব কাঁধে ফেলে সোচ্চারে ঘোষণা করছেন,
‘ আমি হিজাব আর পরি না, পরবো না। ‘
এ যেন মুক্তির আনন্দ। স্বাধীনতার আনন্দ। নিজের মতো করে বাঁচার আনন্দ।
ধর্মীয় অনুশাসনে শাসিত একটি দেশে ঘটমান এই বিদ্রোহ কিন্তু সারা বিশ্বের কাছে ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ।
রক্ষণশীলতার বেড়া সরিয়ে ফতোয়ার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে মহিলাদের নেতৃত্বে এই হিজাব-বিরোধী স্বতস্ফুর্ত গণঅভ্যুত্থান দেশে দেশে মৌলবাদীদের বুক কাঁপিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। বিক্ষোভ দমনে সরকারি বাহিনীর হাতে অসংখ্য বিদ্রোহীর মৃত্যু হচ্ছে। কিন্তু বিদ্রোহীরা ভ্রুক্ষেপহীন।
নীতিবাক্যের আড়ালে মানুষের স্বাধিকার হরণ যে শাসকের অন্যতম প্রধান অস্ত্র তা তো পৃথিবী দেখে আসছে সভ্যতার আদিকাল থেকেই। এখানেও দেখা যাচ্ছে পুলিশ, নীতিসেনা ও ধর্মীয় বাহিনী একজোট হয়ে বিক্ষোভকারীদের দমনে নেমেছে। এ তো খুবই চেনা দৃশ্য।
১৯৭৯ সালে ধর্মীয় বিপ্লবের প্রায় ৪৫ বছর পরে ইরান যেন আরও একবার অভ্যুত্থানের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। নারীপুরুষ নির্বিশেষে সকলেই এই লড়াইয়ে সামিল হচ্ছেন। নতুন ইতিহাস রচনার পথে এখন ভীষণ দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে ইরানের হিজাব-দহন উৎসব, যা এইমুহূর্তে মানব সভ্যতার জীবিতাবস্থার জলন্ত উদাহরণ।
‘এই পথে আলো জ্বেলে, এ পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে। ‘ জীবনানন্দ কবির আশা পূরণে ইরানের হাত ধরে আরও একধাপ এগোতে চলেছে মহাপৃথিবী।
আরও পড়ুন- হেমন্ত মিত্রের জবানবন্দি, উৎপল সিনহার কলম