
আরে, তুমি তো দেখছি চানক্যের মতো বোকা!
গরম খিচুড়ির মাঝখানে হাত দেয় কেউ? হাত তো পুড়বেই, মুখও।
খিচুড়ি খাওয়া শুরু করতে হয় একেবারে ধার থেকে। পরে ধীরে ধীরে একেবারে শেষে আসতে হয় মাঝখানে।
যুদ্ধে পরাজিত ও বিধ্বস্ত চানক্য নগরপ্রান্তে এক একাকিনী বৃদ্ধার আতিথ্য গ্রহণ করেছেন কোনো এক বিষন্ন মধ্যাহ্নে। তখন বুড়ি-মায়ের দেওয়া খিচুড়ি খেতে গিয়েই এই বিপত্তি। ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর আনমনা চানক্য প্রথমেই হাত দিয়েছেন উত্তপ্ত খিচুড়ির মাঝখানে। তখনই বৃদ্ধার উপহাসমাখা ভর্ৎসনা। বৃদ্ধা কি আর জানতেন তাঁর সেদিনের অতিথি স্বয়ং চানক্য?
শোনা যায় বুড়ি-মায়ের কাছে পাওয়া এই শিক্ষা বদলে দিয়েছিল চানক্যের জীবন।
প্রায় একই রকম আরও একটি ঘটনার কথা শোনা যায় কোনঠাসা চানক্যের ঘুরে দাঁড়ানো নিয়ে।
নন্দ রাজবংশের শেষ রাজা ধনানন্দের দরবারে গিয়ে কোনো কারণে অপমানিত হয়ে ফেরেন চানক্য। আর সেই অপমানের বদলা নিতে ধনানন্দকে ক্ষমতাচ্যুত করার ছক কষতে থাকেন অবিরাম। তাঁর এই রণকৌশলের সবচেয়ে বড়ো সঙ্গী ছিলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। চন্দ্রগুপ্ত প্রথমেই চানক্যের পরামর্শে রাজধানী পাটলিপুত্র আক্রমণ করেন এবং নন্দরাজার কাছে পরাজিত হন।
কূটনীতিক ও রাজনীতিক হিসেবে চানক্যের নাম অমর হয়ে আছে ইতিহাসে। কিন্তু এ হেন চানক্যও তাঁর উত্থানের শুরুতে সাধারণ গৃহস্থের কাছে শিক্ষা গ্রহণ করে নিজের ভুল সংশোধন করেছিলেন।
নন্দরাজার কাছে পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে প্রায় দিশেহারা অবস্থায় যখন চানক্য এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করছিলেন তখন হঠাৎই তাঁর কানে আসে এক মা তাঁর ছেলেকে তিরস্কার করছেন এই ব’লে যে, গরম রুটির মাঝখানটা প্রথমে খাওয়ার চেষ্টা করলে হাত তো পুড়বেই। নির্বোধ চানক্যের মতো কাজ করলে মুখ তো পুড়বেই।
এই তিরস্কার শুনে নিজের ভুল বুঝতে পারেন চানক্য। বুঝতে পারেন যে কোনো রাজ্যের মূল শক্তি সেই রাজ্যের রাজধানী। সেখানেই সমস্ত শক্তি সঞ্চিত থাকে। কিন্তু রাজ্যের সীমানাগুলো সেই তুলনায় অনেক দুর্বল ও অরক্ষিত। তাই রাজধানী আক্রমণ করতে হয় একেবারে শেষে। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে সহজ পাঠ গ্রহণ ক’রে ঘুরে দাঁড়ান চানক্য, জয়ী হন, অপমানের প্রতিশোধ নেন এবং নন্দবংশ ধ্বংস ক’রে ইতিহাস রচনা করেন।
মোঘলদের সঙ্গে রাজপুতদের যুদ্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। সম্রাট আকবরের সঙ্গে মহারানা প্রতাপ সিংহের দীর্ঘ লড়াইয়ের কথা কে না জানেন ? সংখ্যায় কম সৈন্য ও রসদ নিয়েও রানা প্রতাপ সারাজীবন বিশাল মোঘল বাহিনীর বিরুদ্ধে লাগাতার অসম লড়াই চালিয়ে গেছেন। কিছুতেই নতিস্বীকার করেন নি। এ হেন আত্মমর্যাদাসম্পন্ন রানা প্রতাপও ক্রমাগত যুদ্ধ করতে করতে একসময় ক্লান্ত ও হতাশ হ’য়ে পড়েছিলেন। আকবরের পাঠানো সন্ধিপ্রস্তাব বারবার প্রত্যাখ্যান করেন রানা। শেষে বিখ্যাত হলদিঘাটের যুদ্ধে আকবরের ৮০০০০ সৈন্যের বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে মাত্র ২০০০০ রাজপুত সেনা যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। আফগান ও ভীল সেনাদের একটি অংশও রানার পক্ষে লড়াই করে। মরণপন লড়াই চালিয়েও রাজপুতেরা শেষপর্যন্ত এই যুদ্ধে পরাজিত হয়।
একদিকে প্রচুর রাজপুত সেনার মৃত্যু ও অন্যদিকে প্রবল অর্থাভাবে রানা কিছুটা হতাশ ও দিশেহারা হয়ে পড়েন। সেই সঙ্কটমুহূর্তে এগিয়ে আসেন রানার দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত এক অনুচর। তাঁর নাম সম্ভবত ভামা শাহ। তিনি তাঁর সারাজীবনের অর্জিত বিশাল পরিমাণ সঞ্চিত অর্থের সমস্তটাই রানা প্রতাপের হাতে তুলে দেন। এই অপ্রত্যাশিত ঘটনা রানাকে নতুন ক’রে লড়াই শুরু করার প্রেরণা দেয়। ঘুরে দাঁড়ান দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া রানা প্রতাপ। আবার শুরু করেন মোঘলদের বিরুদ্ধে মরণপন যুদ্ধ। রচিত হয় কোনো অবস্থাতেই বশ্যতা স্বীকার না করার মহার্ঘ্য ইতিহাস।
ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বারবার পরাজিত, বিধ্বস্ত, ক্ষতবিক্ষত ও চূড়ান্ত হতাশ রবার্ট ব্রুশ স্কটল্যান্ডের সীমান্তে গভীর অরণ্যের মাঝে একটি পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিয়েছেন। আশাহীন, নিশ্চেষ্ট ও সাংঘাতিক আহত রবার্ট মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছেন। পাহাড়ের ভাঙা ফাটল দিয়ে গুহার মধ্যে এসে পড়েছে দিন শেষের মরা আলো। সেই আবছা আলোয় তিনি দেখলেন একটি মাকড়সা দেওয়ালের গায়ে জাল বোনার চেষ্টা করে চলেছে এবং বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। পাহাড়ের পিচ্ছিল দেওয়ালে জাল বুনতে বুনতে মাঝপথেই বারবার জাল ছিঁড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু মাকড়সাটি কিছুতেই হতোদ্যম হয়ে হাল ছাড়ছিল না। একই নিষ্ঠায়, একই একাগ্রতা ও একই উদ্যমে সে বারংবার ব্যর্থতার পরেও জাল বোনার প্রাণপন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। অবশেষে শতবার ব্যর্থ হওয়া মাকড়সাটি একসময় সফল হলো। জাল বুনতে সমর্থ হলো শেষপর্যন্ত।
অতি নগণ্য এই কীটের অসীম অধ্যবসায় ও নাছোড় মানসিকতায় দারুণ অনুপ্রাণিত হলেন রবার্ট ব্রুশ। নতুনভাবে জেগে উঠলেন। ঘুরে দাঁড়ানোর শপথ নিলেন। পরদিন ভোর থেকেই আবার নতুন উদ্যমে সৈন্য ও রসদ সংগ্রহে নামলেন রবার্ট। কিছুকাল পরেই আবার অবতীর্ণ হলেন যুদ্ধে এবং এবার তিনি সফল হলেন। বানুকবার্ণের যুদ্ধে বৃটিশদের পরাজিত করলেন তিনি।
আরও পড়ুন- স্পাইসজেটের বিমানে বিপত্তি, চালকের লাইসেন্স বাতিল করল DGCA
যুদ্ধজয়ী রবার্ট কিন্তু আমরণ ভোলেন নি তাঁর ঘুরে দাঁড়ানোর প্রেরণা মাকড়সাটিকে।