
‘ পঁয়তাল্লিশ বছর বাদে দেখা,
তবু কারও ভুলভাল হল না।
এসপ্ল্যানেডে বর্ষার সন্ধ্যায়
এক-নজরে দুজনেই দুজনকে চিনলুম। পক্ককেশ প্রৌঢ় পরক্ষণে বালকের মতো হাসল, প্রশ্ন করলো, ” কী রে,
আজকাল কোত্থেকে ঘুড়ি কিনিস? আবদুল মৌলালির মোড়ে এখনও লাটাই ঘুড়ি টানা মাঞ্জা বিক্রি করে নাকি? ” ( কবিতা : জয় কালী
কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী )
এই প্রশ্ন শুনে কবি তো অবাক! কথা নেই, বার্তা নেই, কেমন আছিস ভালো আছি নেই, কোনোরকম কুশল বিনিময়ের তোয়াক্কা নেই, দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছর বাদে রাস্তায় হঠাৎ দেখা হতেই সোজা মনের ঘাড় ধ’রে টেনে নিয়ে গেল এক্কেবারে কৈশোরে? ঘুড়ি লাটাই ছাড়া আর কিছু মনে পড়লো না এই বর্ষামুখর সন্ধ্যায়?
কবি যে আর তিন বছর বাদে অবসর নেবেন চাকরি থেকে অথচ দু-দুটো মেয়ের একটাও পাত্রস্থ হয় নি, বাড়ির বাবদে ঘাড়ে দেনা, পেটে অম্লশূল, সাংসারিক দায়-দায়িত্ব দিনে দিনে বেড়েই চলেছে, উপরন্তু গিন্নির হাঁপানি, এইসব সাতকাহন বলার তো কোনো সুযোগই দিল না হতচ্ছাড়া কালীপদ! হতচ্ছাড়া কেলো!
একবারও বললো না, ‘ কী খবর বল, কতদিন দেখা হয় নি… ‘, উল্টে টেনে নিয়ে গেল পেটকাটি চাঁদিয়াল মোমবাতি বগ্গায়! কবি কি এখনো এগারো বছরের বালক নাকি?
যদিও এসপ্ল্যানেড থেকে মৌলালির দূরত্ব খুব বেশি নয়, মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছর! কিন্তু এখন জীবনের গোধূলি পার করা এই বর্ষাসন্ধ্যায় এসপ্ল্যানেডে হঠাৎ এতকাল পরে দেখা হতেই যে প্রশ্নগুলো অনিবার্য ছিল সেগুলো কোথায়? সব ছেড়ে ঘুড়ি ওড়াবার কথা বলে কেন কালীপদ মল্লিক?
আচ্ছা, কালীপদ, মানে আমাদের কেলো, এখন থাকে কোথায়? ও কি বিয়ে-থা করেছে? নাকি, একাই থাকে? ওর বাড়িতে কে কে আছে? ও কি এখনও সেই কলম্বাস, নাকি রবিনসন ক্রুশো? ও কি এখনও মাঠে ঘুড়ি, ছাদে ঘুড়ি, ঢাউস ঘুড়ি, পুচকে ঘুড়ি, টানা-মাঞ্জা, ঘসা-মাঞ্জা নিয়েই উড়ে বেড়ায় আকাশে? স্বাধীন পাখির মতো ওই কিশোর মনটাকে এতযুগ পরেও কী করে বাঁচিয়ে রাখলো কালী!
ওর গ্যাস-অম্বল নেই? হাঁটুর ব্যথা নেই? ঘুমের ওষুধ খায়? সরবিট্রেট রাখে পকেটে? গিন্নির খবর আদান-প্রদানে তো কোনো আগ্রহই দেখালো না ব্যাটা কেলো!
আরও পড়ুন- সেতারে জিলা কাফি, উৎপল সিনহার কলম
এদিকে ডাইনে বাঁয়ে নেভে আর জ্বলে বিজ্ঞাপনী বর্ণমালা। আকাশে পুজোর গন্ধ। গঙ্গা থেকে ছুটে আসে হাওয়া। কবি বলছেন এইরকম সন্ধ্যালগ্নে ভিখারীও স্বপ্ন দেখে, আর যেন জাদুদণ্ডের ছোঁয়ায় পাল্টে যায় কলকাতার মুখচ্ছবি। চৌরঙ্গীর মোড়ে মেট্রো-রেলের দেওয়ালে প্যান্টের বোতাম খুলে যারা ভারমুক্ত হচ্ছে, তাদেরও এখন বালকের মতো সুখী ও নিশ্চিন্ত বলে মনে হয়। তাবলে সময় তো আর থেমে থাকে না, অথৈ সংসারসমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে কেউ থৈ পায় না, আবার কেউ নিশ্চিন্তে সাঁতরাতে থাকে, ডুবতে ডুবতেও ডোবে না, ভেসে থাকে শেষপর্যন্ত। মনও তো তাই। কোনো মন মরেই যায় সংসারের প্রচণ্ড চাপে, ঝরে যায় দমকা হাওয়ায়, আবার কোনো মন কিছুতেই মরতে চায় না, কোনো চাপের কাছেই নতিস্বীকার করতে চায় না কিছুতেই।
কবির কথা তো শুনলোই না, আর, নিজের কথাও কিছুই বললো না কালী। অথচ বর্ষার এই সন্ধ্যায় দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছর পর কত কথাই তো হতে পারতো দুই বাল্যবন্ধুর। চায়ের ভাঁড় হাতে নিয়ে এত বছরের জমানো স্মৃতির ঝাঁপি খোলা যেত অনায়াসেই। সেসব কিছুই হলো না।
আচ্ছা, হতচ্ছাড়া কেলোর জীবনে কি কোনো শোক-দুঃখ নেই? কোনো জমানো ব্যথাবেদনা? শারীরিক কষ্ট? কোনো না পাওয়ার হাহাকার? অথবা এমন কোনো গূঢ় ঘটনা যা একমাত্র শৈশবের বন্ধুকেই বলা যায়? নাকি, ওর গোটা জীবন জুড়েই ঘটনার ঘনঘটা! ও কি ইচ্ছে করেই জীবনের একঘেয়ে কাসুন্দি ঘাঁটার পথে গেল না? এগারো বছরের বালকের স্বপ্নমাখা রঙিন মায়াজগৎ ছেড়ে ও কি বেরোতে পারে নি আজও? কী করে সম্ভব হলো এটা?
মৌলালির আবদুলের কথা তো মনেও পড়ে না কতকাল। টানা-মাঞ্জা, লাটাই-ঘুড়ি সবই তো গেছে জলাঞ্জলি সেই কবে। ছাপ্পান্ন বছরের জীবন থেকে পঁয়তাল্লিশটা মহামূল্য বছর যেন ডাকাতি ক’রে নিয়ে গেল সংসারের যাঁতাকল। একেবারে পঙ্গু, অথর্ব করে দিয়ে গেল। নিঃস্ব, নিঃসঙ্গ, সর্বস্বান্তের মতো ফ্যালফ্যাল ক’রে মহাশূন্যের দিকে চেয়ে থাকে আনন্দহীন জীবন এখন । কোথায় লাটাই, কোথায় ঘুড়ি, কোথায় আবদুল, কোথায় মৌলালি?
‘ কালী, হয় তুই উন্মাদ কিংবা গাধা।
এই কথাটা বলতে গিয়ে পরক্ষণে ভাবি, পাগল কি নির্বোধ নয়, যেখানে একদিন ছেড়েছিল, কালী হয়তো
হার-না-মানা গোঁয়ারের মতো মধ্যবর্তী বছরগুলিকে অস্বীকার করতে চাইছে, আর একদম সেইখান থেকে ধরতে চাইছে পুরনো বন্ধুকে।
ধরা যায় না, কে না জানে,
ইঁদারায় ঝুঁকে কোনো- কিছু ধরতে গেলে খালি বেদনাই বাড়ে।
তবুও অস্ফুট কণ্ঠে বলি তাকে, ” জয় কালী, জয় কালী! ”
আরও পড়ুন- অন্তহীন বাইশে শ্রাবণ, উৎপল সিনহার কলম