
” তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি বিচিত্র ছলনা-জালে, হে ছলনাময়ী।
মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুন হাতে সরল জীবনে।
এই প্রবঞ্চনা দিয়ে মহত্বেরে করেছ চিহ্নিত ; তার তরে
রাখ নি গোপন রাত্রি।
তোমার জ্যোতিষ্ক তারে যে পথ দেখায় সে যে তার অন্তরের পথ, সে যে চিরস্বচ্ছ,
সহজ বিশ্বাসে সে যে করে তারে চিরসমুজ্জ্বল। বাহিরে কুটিল হোক অন্তরে সে ঋজু,
এই নিয়ে তাহার গৌরব।
লোকে তারে বলে বিড়ম্বিত।
সত্যেরে সে পায় আপন আলোকে ধৌত অন্তরে অন্তরে। কিছুতে পারে না তারে প্রবঞ্চিতে, শেষ পুরস্কার
নিয়ে যায় সে যে আপন ভাণ্ডারে। অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে
সে পায় তোমার হাতে
শান্তির অক্ষয় অধিকার। ”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সর্বশেষ কবিতা। তখন কলম ধরতে হাত কাঁপে কবির। রুগ্ন, শয্যাশায়ী। মুখে মুখে বলেন।
কেউ লিখে নেয়।

বাঙালির কাছে পঁচিশে বৈশাখ আনন্দের, আর বাইশে শ্রাবণ বিষাদের। বাঙালির জীবনে মনীষীর অভাব হয় নি কোনোদিন। কিন্তু এতটা ব্যাপ্তি, এতটা প্রতিভা নিয়ে কেউ কি এসেছেন? একজন মানুষ গান লিখছেন, সুর করছেন, গাইছেন ও শেখাচ্ছেন, এটা তো কোনো বিরল ঘটনা নয়। একজন মানুষ কবিতা লিখছেন, আবৃত্তি করছেন এবং অন্যান্যদের শেখাচ্ছেন, এও তো কতোই দেখি আমরা। কিন্তু একজন মানুষ একইসঙ্গে গান, কবিতা, নাটক, ছোট গল্প, বড় গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও নিবন্ধ, গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্য বছরের পর বছর ধরে লিখে যাচ্ছেন, ছবি আঁকছেন, একটা ভাষা ও সাহিত্যে রেনেশাঁ আনছেন, নবজীবন দান করছেন, একটা জাতিকে উত্তর-আধুনিকতার সন্ধান দিচ্ছেন সারাজীবন ধ’রে এমন বিরল ঘটনা ঘটাতে পারেন ক’জন? তাঁর লেখা চিঠিপত্রগুলিও পত্রসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হয়ে আছে। শুধু কি তাই? নাট্যকার, নট ও নির্দেশক রবীন্দ্রনাথ বাংলা নাটককে এক অনন্য পথের দিশা দিয়ে গেছেন যার প্রাসঙ্গিকতা সহজে ফুরোবার নয়। গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ ক’রে বাঙালির হাতে নোবেল পুরস্কার তুলে দেওয়া প্রাণতপস্বী রবি ঠাকুরের বক্তৃতা শোনার জন্য একসময় সারা পৃথিবীর মনীষীরা উৎকর্ণ হয়ে থাকতেন। তাঁর দেশাত্মবোধ, পরাধীন দেশে বৃটিশ শাসকের অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সরাসরি প্রতিবাদ আজ ইতিহাস। দেশকাল, রাষ্ট্র, সমাজ ও সভ্যতার অগ্রগতির ক্ষেত্রে তাঁর ভাবনা ও পরামর্শ আজও আধুনিক বিশ্বকে পথ দেখায়। তাঁর মানসজাত
শান্তিনিকেতন, শ্রীনিকেতন ও সমবায়- ভাবনা আমাদের বিস্মিত ও মুগ্ধ করে। আশি বছরের পরমায়ু নিয়ে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে ( একের পর এক প্রিয়জন বিয়োগের বিষাদসিন্ধু অতিক্রম ক’রে ) এমন ফলবান ক’রে তোলা বোধহয় পৃথিবীর আর কারোর পক্ষেই সম্ভব নয়। এক জীবনে পৃথিবীর জন্য এমন সুদূরপ্রসারী কাজ আর কেউ করেছেন কি?
শুধু পরমাত্মীয়, অভিভাবক ও পথপ্রদর্শকই নয়, রবীন্দ্রনাথ আজও বাঙালির কাছে এক বিস্ময়মানব হিসেবেই থেকে গেছেন। আশি বছরের জীবনে একজন ব্যক্তির পক্ষে সাহিত্য, সঙ্গীত ও সংস্কৃতি, দেশ -কাল -সমাজ ও সভ্যতা নিয়ে এমন বিপুল কর্মকাণ্ড সংঘটিত ক’রে যাওয়া কীভাবে সম্ভব হলো তা রীতিমতো গবেষণার বিষয়। রবীন্দ্রনাথ একটি স্বসৃষ্ট আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের নাম। রবীন্দ্রনাথ একটি অনন্য দর্শন।

১৯৪১ সনের ৭ আগস্ট,এক ঝিরিঝিরি দিনে পার্থিব শরীরের মায়া ত্যাগ করেন বাঙালির প্রাণপ্রিয় রবি ঠাকুর। জীবন মরণের সীমানা ছাড়িয়ে বারবার যিনি ফিরে এসে দাঁড়িয়েছেন জনতার মুখরিত সখ্যে অকম্পিত পায়ে তাঁর দীর্ঘ অপরূপ ব্যক্তিত্বের প্রলম্বিত ছায়া নিয়ে, তিনি এবার আর ফিরে এলেন না, তাঁর ফিরে আসার পথ চেয়ে থাকা অগণ্য মানুষের প্রত্যাশা ও প্রার্থনায় আর সাড়া দিলেন না, আর চোখ খুলে দেখলেন না তাঁর ‘ অয়ি ভুবনমনোমোহিনী মা’ -কে বাইশে শ্রাবণের এক বেদনাঘন দিনে। এই অমোঘ সত্যকে শিরোধার্য ক’রে খবরের কাগজের বিশেষ শিরোনামে লেখা হলো
‘ রবি অস্তমিত ‘।
বুদ্ধদেব বসু লিখলেন,
‘ মুহূর্তে সব কাজ থেমে গেল। কলকাতা শহর উপচে পড়লো রাস্তায়, স্কুল কলেজ শূন্য, রাজকার্য অর্থহীন হয়ে গেল। উকিলের শামলা, পাদ্রীর আলখাল্লা, হলুদ আর গেরুয়া রঙের উত্তরীয়, গোল টুপি, বাঁকা টুপি, পাগড়ি, কেউ চলছে, কেউ ছুটছে, কেউ বা দাঁড়িয়ে আছে চুপ ক’রে।
থেকে থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে বৃষ্টি তাঁর যাবার পথটা ধুলিহীন ক’রে দিচ্ছে। ঢেউয়ের পর আসছে ঢেউ, ভেঙে ভেঙে ঢেউ ছড়িয়ে যাচ্ছে। সেই ঢেউয়ের চূড়ায়, তলায়, ফেনায় ফেনায় মহামান্য নেতা থেকে সামান্য মানুষে গড়া জনতা মিলে মিশে একাকার।
তারই মধ্যে শয়ান বনস্পতিকে বহন করে নিয়ে গেল একদল লোক। অথবা সবার আগে আগে ওই যে তিনি নিজেই বুঝি চলেছেন, চলে গেলেন।
এমন নয় যে অকালমৃত্যু, এমন নয় যে অপ্রত্যাশিত, তবু সেই মুহূর্তে কঠিন মাটি ফেটে গিয়ে গহ্বর খুলে গেল। রবীন্দ্রনাথ নেই, কে আমাদের ভালো বাসবেন, শাসন করবেন, কাকে আমরা উত্যক্ত করবো সেই সব তুচ্ছ দাবি নিয়ে, যা শুধু তাঁরই হাতে রত্ন হয়ে উঠতো। স্বদেশের সংকটের সময় কে আমাদের পরামর্শ দেবেন, তর্কযুদ্ধ মিটিয়ে দেবেন কে? জগতটাকে এনে দেবেন আমাদের দরজায়, আমাদের নবজাত সন্ততির নামকরণ করবেন, আমাদের জীবনে ও প্রতিষ্ঠানগুলিতে অর্পণ করবেন স্বীয় মর্যাদা।
আরও পড়ুন- ফের বাংলাকে বঞ্চনা, মুখ্যমন্ত্রীকে অপমান: মোদির ডাকা বৈঠকে বলতে দেওয়া হলো না মমতাকে
এতক্ষণ শক্ত ছিলাম, না পারছি সদ্য সৃষ্ট শূন্যতাকে পূরণ করতে, না আছে শক্তি
‘ তবু শূন্য শূন্য নয় ‘ বলতে।
কিন্তু যেই চোখে পড়লো টেবিলের ওপর রাখা তাঁর
সঞ্চয়িতা কাব্য সংকলনটি,
সেই মুহূর্তে নিজেকে আর ধরে রাখা গেল না, একটা আঘাত ভেতরটাকে আমূল কাঁপিয়ে দিয়ে গেল, যেন এই দেখাটুকুরই অপেক্ষায় ছিলাম। কতবার পড়া তাঁর কবিতাগুলোকে মনে হলো অনাথ, পিতৃহীন। স্রষ্টার অন্তর্ধানে তাঁর সৃষ্টি কি করুণ।
আস্তে আস্তে বাষ্প জমছে চোখের পাতায়। মনের দিগন্তে আর কালো কোমল ছায়ায় টের পাচ্ছি, ঢেকে যাচ্ছে,
সূর্যগ্রাসের সময় যেমন ঢাকে।
অঝোর বর্ষণ তখন আর বাইরের প্রকৃতিতে নেই। সেই
জলধারা ঠাঁই নিয়েছে ঘরে ঘরে, টলমল মনের পর মনে।
পরিবেশ যখন স্নাত, স্নিগ্ধ, তখন বহ্নিমান চিতা জ্বলছিল
গঙ্গার কোলে। ‘







































































































































