
‘এমন ঘরে আমায় কেন
জন্ম দিলি মা
সারাটা রাত জল পড়ছে
পাতা নড়ছে না’
( ভবতোষ শতপথী )
আদি কবি লিখলেন, ‘ জল পড়িতেছে পাতা নড়িতেছে। ‘
এই জল পড়ার মৃদু ছন্দটি দুলিয়ে দিলো এক বালককে। ভুলিয়ে দিলো আর সবকিছু। তার চৈতন্য জুড়ে সমস্ত দিন ধরে জল পড়তে ও পাতা নড়তে লাগলো। এই বালক সাবালক হ’য়ে লিখলেন,
‘ জল পড়ে পাতা নড়ে।’
আদি কবির লেখা ঘটমান বর্তমানকে নিত্য বর্তমান-এ রূপান্তরিত করলেন আধুনিক কবি। লিখলেন, ছন্দ থেমে গেলেও, বক্তব্য শেষ হলেও তার ঝংকারটা যেন ফুরায় না। মিল জিনিসটা এমনই প্রয়োজনীয়। অন্ত্যমিল।
কিন্তু, শুধু জল পড়লেই যে পাতা নড়ে তা তো নয়।
হাওয়ার দোলায়, কখনও বা ধাক্কায় পাতা কি নড়ে না? আরও নানা কারণে নড়তেই পারে পাতা। কিন্তু, ‘ জল পড়ে পাতা নড়ে ‘ ছন্দটি মনের মধ্যে অপূর্ব এক আলোড়ন তোলে কেন? কেন এই ছন্দোবদ্ধ বাক্যবন্ধটি হৃদয়ে আনন্দহিল্লোল তোলে? সে কি শুধুমাত্র ধ্বনি ও ছন্দের কারণে? কেবল উল্লিখিত বালকের চৈতন্যেই নয়, পরিণত মনকেও কি যথেষ্ট দোলা দেয় না জল ও পাতার এই আশ্চর্য মিতালি?
এ যেন এক বার্তা। জল পড়লেও পাতা যদি না নড়ে তাহলে যেন সভ্যতার অগ্রগতি থমকে থাকে, এমনই কোনো গূঢ় সঙ্কেত যেন নিহিত আছে এই সহজ সরল কথাগুলির মধ্যে।
জলরূপ বিদ্যা ও জ্ঞানের ছিটে যতক্ষণ না পাতারূপ চেতনায় টুপটাপ ক’রে পড়ে ততক্ষণ পাতা নড়ে না। বিদ্যা, জ্ঞান, অনুভব ও উপলব্ধি যেন জলের রূপ ধ’রে চেতনারূপ স্থির ও অচঞ্চল পাতার ওপর পড়ে। তখন পাতা নড়ে। চেতনা চৈতন্য হয়।
সুবক্তা অধ্যাপক শুভঙ্কর চক্রবর্তী বহুকাল আগে তাঁর একটি বক্তৃতায় সংস্কৃতি ও অপসংস্কৃতির সংজ্ঞা ও স্বরূপ বিশ্লেষণ করেছিলেন একটি সহজ উদাহরণের মাধ্যমে।
‘ ছেলেবেলায় আমরা থাকতাম আমাদের গাঁয়ের বাড়িতে। তখনও বিজলিবাতি আসে নি। আমাদের মায়ের নিপুন হাতে নিকোনো উঠোনে মাদুর পেতে ভাইবোনেরা পড়তে বসতাম রোজ সন্ধ্যায় হ্যারিকেনের আলোয়। মা প্রতিদিন সযত্নে হ্যারিকেনের কাচটি উনুনের জ্বালানি-পোড়া ছাই দিয়ে পরিষ্কার করে দিতেন যাতে আলো উজ্জ্বল হয়। আমরা পড়তে বসে দুষ্টুমি ক’রে হ্যারিকেনের পলতেটি উস্কে দিতাম, আর সঙ্গেসঙ্গেই কাচটি কালো ধোঁয়ায় ভ’রে গিয়ে চারদিক অন্ধকার হয়ে যেত। আর পড়তে হবে না ভেবে আমরা সমস্বরে উল্লাস ক’রে উঠতাম, আর উৎকন্ঠিত মা ‘ কী হল, কী হল ‘ ব’লে ছুটে এসে হ্যারিকেনের পলতেটি স্বস্থানে নিয়ে আসতেন, আবার কখনো কখনো পরিস্কার কাপড় দিয়ে কাচটি মুছেও দিতেন। আবার আলো জ্বলে উঠতো। পড়া শুরু হতো।
তখন বুঝতাম না, কিন্তু আজ বুঝি, আমরা যে কাজটি করতাম তা অপসংস্কৃতি, আর , মা যে কাজটি করতেন তাকে বলে সংস্কৃতি। ‘
মা তো স্বয়ং আলো। আদি আলো। প্রথম আলো। এখানে জল হ’য়ে পাতা নড়ালেন মা।
ভারতের একসময়কার প্রধান নির্বাচন কমিশনার টি এন শেষন একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে সস্ত্রীক রওনা হয়েছেন উত্তরপ্রদেশের কোনো একটি স্থানের অভিমুখে। পথে একটি তালবাগান অতিক্রম করার সময় চোখে পড়লো তালগাছে অজস্র বাবুইপাখির বাসা ঝুলছে। দেখে তাঁর স্ত্রী আগ্রহ প্রকাশ করলেন দুটি বাসা তিনি বাড়িতে নিয়ে যাবেন। এসকর্টের লোকেরা সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা একটি রাখাল ছেলেকে দুটি বাসা পেড়ে দেওয়ার জন্য বারবার অনুরোধ করা সত্বেও ছেলেটি রাজি হলো না। শেষন কত বড়ো অফিসার, কী তাঁর পরিচয়, এসব বলাতেও কোনো লাভ হলো না। শেষে শেষন সাহেব নিজে এগিয়ে এসে তাকে দশটাকা বকশিস দিয়ে প্রলুব্ধ করতে চাইলেন। এমনকি পঞ্চাশ টাকা দিতে চাইলেও সে রাজি হলো না।
রাজি না হওয়ার কারণ হিসেবে সে জানালো, ‘ এই বাসাগুলোতে একটি করে পাখির বাচ্চা রয়েছে, মা পাখিটা যখন খাবার নিয়ে এসে তার বাসা ও বাচ্চাটিকে দেখতে পাবে না, তখন তার কান্না আমি সহ্য করতে পারবো না। আপনি আমাকে যতকিছুই দিতে চান না কেন, কোনোকিছুর বিনিময়েই এই কাজটি আমি করতে পারবো না। ‘
টি এন শেষন তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন,
‘ মুহূর্তে মনে হলো আমার সমস্ত বিদ্যাবুদ্ধি, উচ্চ পদমর্যাদা সবকিছুই এই রাখাল ছেলেটির কাছে একদানা শষ্যেরও সমতুল্য নয়। ‘ শেষন বলেছেন, এই অভিজ্ঞতা তিনি সারাজীবন বয়ে বেড়িয়েছেন।
যে বিদ্যা জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত করে না, বিবেক জাগ্রত করে না, তা অন্তঃসারশূন্য বোঝামাত্র।
জল পড়লো। পাতাও নড়লো।
এবার জল হ’য়ে পাতা নড়ালো রাখাল ছেলেটি।
আরও পড়ুন- Dengue: রাজ্যে ডেঙ্গু রোধে একাধিক সতর্কতা জারি নবান্নের