কে বোঝে কার মন, উৎপল সিনহার কলম

0
1
উৎপল সিনহা

‘ মনে হলো মোর দুখরাতে

যেমন ক’রে ভোলাতে

মন হারালো হারালো
মন হারালো সেইদিন… ‘
( কথা ও সুর : সলিল চৌধুরী
কন্ঠ : হেমন্ত মুখোপাধ‍্যায় )

আহা, কী অপূর্ব কথা! তেমনি অনবদ‍্য সুর। আর, কন্ঠে যাঁর চিরবসন্ত তিনি গেয়েছেন এই কালজয়ী গানটি।
কিন্তু হায়, আজ এই নিষ্ঠুর নির্মম সময়ে অসংখ্য মানুষের অনন্ত দুখরাতে কে কাকে ভোলায়? যদি ভোলানোই যেত তাহলে চূড়ান্ত হতাশা আর চারপাশের নিস্পৃহতার গুরুভার সইতে না পেরে একের পর এক সম্ভাবনাময় নবীন প্রাণ আত্মঘাতী হতো না। দুখরাত মানুষের জীবনে আবহমান, কিন্তু ভোলানোর সেই সংবেদনা আজ কোথায়? আজ তো কারোর জন্য কারো সময় নেই। অপরের মন বোঝা, অন‍্য মনের যন্ত্রণা উপলব্ধি ক’রে তার শুশ্রূষা করার নরম হৃদয় কোথায়? কোথায় ভরসা ও আশ্বাসের শীতল শীতল কথা? সময় বড়ো কর্কশ ও কঠিন আজ, বড়ো নৃশংস।

দুঃখ ভোলানোর গান কিন্তু পৃথিবীর সব ভাষাতেই লেখা এবং গাওয়া হয়। শুধু ভোলানোই নয়, টানা বিপন্নতায় উদভ্রান্ত, দিশেহারা ও জীবনবিমুখ মনগুলোকে নতুন করে বাঁচার পথও বলে দেয় এইসব মৃতসঞ্জীবণী সুধায় ভরপুর অসামান্য গানগুলি। মানসিক অবসাদে ছেঁড়াফাটা বিমর্ষ হৃদয়গুলোর চিকিৎসায় অন‍্যতম সহায়ক শক্তি হিসেবে পাশে এসে দাঁড়ায় গান।

উর্দু ভাষায় রচিত অনন‍্যসাধারণ একটি গীত ( গজল ) এ প্রসঙ্গে উল্লেখ না করলেই নয়।

‘ কহাঁ আকে রুকনে থে রাস্তে
কহাঁ মোড় থা উসে ভুল যা
উয়ো যো মিল গয়া উসে
ইয়াদ রখ
যো নেহিঁ মিলা উসে ভুল যা।

উয়ো তেরে নসীব কী বারিশেঁ
কিসি ঔর ছত পে বরস গই,
দিলে-বেখবর মেরি বাত সুন
উসে ভুল যা উসে ভুল যা।

মেঁ তো গুম থা তেরে হি ধ‍্যান মে,
তেরি আস তেরে গুমান মে
হওবা কহে গই মেরে কান মে
মেরে সাথ আ উসে ভুল যা।

তুঝে চাঁদ বনকে মিলা থা যো,
তেরে সাহিলোঁ পে খিলা থা যো
উয়ো থা এক দরিয়া বিসাল কা,
সো উতর গয়া উসে ভুল যা। ‘
( গজল : আমজাদ ইসলাম
সুর ও কন্ঠ : গুলাম আলী )

কী বার্তা দেওয়া হচ্ছে এই গজলটিতে?
কী কী পাওয়ার কথা ছিল অথচ পাওয়া গেল না সেসব ভেবে বিমর্ষ না হয়ে কী কী পাওয়া গেল সেগুলোর কথা ভেবেই আনন্দে থাকতে হবে।
কী পাওনি তা ভুলে যাও। যা পেয়েছো ও যতটুকু পেয়েছো সেটাই বা কম কি?
সৌভাগ্যের মেঘ তোমাকে ফাঁকি দিয়ে অন‍্যের উঠোনে কেন প্রসাদবারী হয়ে ঝরেছে তা নিয়ে মনখারাপ না ক’রে সেটাকে একটা দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যেতে হবে।
জীবনে যাকে পাওয়া যাবে না তার কথা ভেবে নৈরাশ‍্যের চোরাবালির অতলে তলিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে বাতাস এসে কানে কানে বলে, ‘ আমার সঙ্গে এসো, বাকি সব ভুলে যাও।’

যে চাঁদের আলোর স্নিগ্ধতায় একদিন ভরিয়ে দিয়েছিল তোমার চিদাকাশ, সেই মিলনোন্মাদনা আজ স্তিমিত হয়ে গেছে, জীবন থেকে সরে গেছে, বিদায় নিয়েছে, তাকে আর কেন মনে রাখা? ভুলে যাও। যে স্মৃতি কেবল যন্ত্রণাই দিয়ে যাবে আমরণ, প্রতি মুহূর্তে ক্ষতবিক্ষত করবে হৃদয়কে, কুরে কুরে খাবে জীবনটাকে, নিরাশা ও বিষন্নতার অতল অন্ধকারে ঠেলে দেবে কোমল মনটাকে, সেই প্রাণঘাতী বেদনস্মৃতি ব’য়ে বেড়িয়ে কী লাভ? কেবলমাত্র অতীতচারণা করেই কি জীবন কাটবে? সামনে তাকাতে হবে না? যদিও একথা ঠিক যে ভুলে যেতে বললেই ভুলে যাওয়া সহজ নয়।

সব গান নয়, কিন্তু কোনো কোনো গানের থাকে অসীম ক্ষমতা। সেই গানের ভেতরে থাকে অতুল ঐশ্বর্য, জীবনদায়ী প্রেরণা ও বিরামহীন শুশ্রূষা। জীবনের কুরুক্ষেত্রে সেই গান অবশ‍্যই হয়ে উঠতে পারে মৃত্যুর বিরুদ্ধে প্রাণপণ যুদ্ধে প্রধান সহযোগী তথা সারথী। যন্ত্রণার প্রবল স্রোতকে উল্টোমুখে ঘুরিয়ে দিয়ে আত্মহননকামীর আত্মবল বাড়িয়ে তাকে নতুনভাবে বাঁচার পথ বলে দিতে পারার ক্ষমতা রাখে কোনো কোনো গান।

গজলের একটা প্রচলিত রীতি হলো ভূমিকা। যাকে মুখবন্ধ বা নান্দীমুখও বলা যেতে পারে। মূল গানটি গাওয়ার আগে কখনো-সখনো সামান্য আলাপের পরেই কয়েকটি ‘ শের ‘ গাওয়া হয় যেগুলোর সঙ্গে মূল গানের তেমন কোনো সম্পর্ক থাকে না। সেগুলি অন‍্য কোনো কবির লেখা হলেও চলে। আজকের আলোচ‍্য গজলটির শুরুতেও তেমন কয়েকটি মনোগ্রাহী ‘ শের ‘ গেয়েছেন গুলাম আলী সাহেব। যেগুলির রচয়িতা স্বনামধন্য কবি আহমেদ ফারাজ। কী লিখেছেন তিনি?

‘ তেরি বাতেঁ হি সুনানে আয়ে
দোস্ত ভি দিল হি দুখানে আয়ে।
ফুল খিলতে হেঁ তো হম সোচতে হেঁ
তেরে আনে কে জমানে আয়ে।
এয়সী কুছ চুপ সি লগি হে য‍্যায়সে
হম তুঝে হাল সুনানে আয়ে।
ক‍্যা কহিঁ ফির কোই বস্তি উজড়ি
লোগ ক‍্যুঁ যশ্ন মনানে আয়ে । ‘

বন্ধু হয়েও তোমার দুঃখগাথা তোমাকেই শোনাতে এসেছি। ফুল ফুটলেই আমরা ভাবি তোমার আসার সময় আসন্ন।

সবাই এমন নিশ্চুপ কৌতুহলী হয়ে অপেক্ষা করছে যেন আমি জীবনকাহিনি শোনাতে এসেছি।
কোথাও কি বস্তি উচ্ছেদ হয়েছে? তবুও মানুষ আনন্দ করতে এসেছে কেন?

আবার ফিরে আসি আজকের মূল আলোচনায়। কথায় আছে কবিদের দুঃখবিলাস নাকি সৃষ্টিশীল। কিন্তু সাধারণের বিষন্নতাব‍্যাধি দুরারোগ‍্য তো বটেই, এমনকি প্রাণঘাতী। এই প্রবণতাও মারাত্মক রকমের সংক্রামক।
মানুষের জীবনে এমন কিছু হৃদয়বিদারক ঘটনা বা দুর্ঘটনা ঘটে যার আঘাত বা অভিঘাত থেকে কিছুতেই যেন বেরিয়ে আসা যায় না। কিছুতেই যেন নিজেকে আর মোটিভেট বা প্রাণিত করা যায় না। তখন অন্তর ও বাহিরের অনুপ্রেরণাদায়ী শক্তিগুলোও যেন অচল ও স্তব্ধ হয়ে পড়ে। অবসাদের ভয়াল এক অন্ধকার জীবনকে যেন গ্রাস ক’রে ফ‍্যালে।

জীবনের এই ঘোরতর দুঃসময়ে প্রয়োজন উপযুক্ত কাউন্সেলিং। রোগ নিরাময়ের পদ্ধতি সংক্রান্ত পরামর্শদান। এক্ষেত্রে গান হয়ে উঠতে পারে অন‍্যতম চিকিৎসক এবং একইসঙ্গে অবসাদ ও বিষন্নতাব‍্যাধির অত‍্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ।

সুরের গতিবেগ কি আলোর চেয়েও বেশি? জানা নেই। কিন্তু এটা অবশ্যই অনেকেরই জানা যে, কিছুকিছু গানের কথা ও সুরের মধ‍্যে যে অভ্রভেদী আলো ও অপার শুশ্রূষা নিহিত থাকে তা এই বিশ্বসংসারের আর কোনো কিছুর সঙ্গেই তুলনীয় নয়।

আরও পড়ুন- পার্কসার্কাস গুলিকাণ্ডে চাঞ্চল্যকর তথ্য: মানসিক সমস্যা ছিল চোড়ুপ লেপচার!