সিপিএমের (CPM) মুখপত্র ‘গণশক্তি’-তে একটি লম্বা-চওড়া সাক্ষাৎকার দিয়েছেন সিপিএমের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি(Sitaram Yechury)। “ধর্ম নিরপেক্ষ শক্তির সর্বোচ্চ ঐক্য গড়ে রুখতে হবে উগ্র হিন্দুত্বকে” শিরোনামে এই সাক্ষাৎকারে ইয়েচুরি কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদি (Narendra Modi)সরকারের সমালোচনা করতে গিয়ে বিজেপির(bjp) কর্পোরেট লুট আর সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে দেশকে গুরুতর বিপদের মুখে দাঁড় করানোর তত্ত্ব আওড়েছেন বটে, তবে কীভাবে এই বুলডোজার রাজনীতি ঠেকানো সম্ভব, তার কোনও সঠিক দিশা দেখাতে পারেননি। বরং, বিজেপি বিরোধিতায় নিজেদের অপদার্থতা ঢাকতে দেশজুড়ে বিভিন্ন রাজ্যে অন্যান্য অবিজেপি দলগুলির ভূমিকাকে ছোট করার চেষ্টা করেছেন।
গণশক্তির সাক্ষাৎকারে যখন প্রতিবেদক প্রশ্ন করেন কীভাবে “ধর্ম নিরপেক্ষ শক্তির সর্বোচ্চ ঐক্য গড়ে রুখতে হবে উগ্র হিন্দুত্বকে” বা এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য সিপিআই(এম)’র ভূমিকা কী হবে? তার কোনও সঠিক দিশা দিতে পারেননি ইয়েচুরি। সেই মান্ধাতার আমলের দলীয় লাইনে হেঁটে তাত্ত্বিক উত্তরেই নিজের বক্তব্য সীমাবদ্ধ রেখেছেন সিপিএমের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক।
ইয়েচুরির উত্তর, “সিপিএমের ভূমিকা হবে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলির যথাসম্ভব সর্বোচ্চ ঐক্য গড়ে তুলে এই উগ্র হিন্দুত্বের আক্রমণের মোকাবিলা করা।” ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি বলতে কাদের বা কোন রাজনৈতিক দলগুলিকে এই ঐক্যে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা হবে? এই প্রশ্নের উত্তর শুনে তাঁর দলের লোকেরাই মুচকি হাসছে। ইয়েচুরির কথায়, “এই ঐক্যে শুধু রাজনৈতিক দল নয়, ইচ্ছুক সব শক্তির কথা বলা হচ্ছে। ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির পাশাপাশি অনেক শক্তির মাধ্যমে গণআন্দোলন ও বহু আন্দোলন হচ্ছে, দলিত অধিকার, সংখ্যালঘু অধিকারের দাবিতে লড়াই হচ্ছে, অরাজনৈতিক সংগঠনও লড়াইতে রয়েছে, তাদের সবাইকে একজোট করতে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করবে সিপিআই(এম)।”
একটানা ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকার পরও বাংলায় বামেরা অপ্রাসঙ্গিক। প্রাসঙ্গিকতা ফিরে পাওয়ার কোনও ফর্মুলাও দল বা দলীয় নেতাকর্মীদের অন্তত গণশক্তির সাক্ষাৎকারে দিতে পারলেন না ইয়েচুরি। বঙ্গে বিজেপি ও তৃণমূলের রাজনৈতিক মেরুকরণ আটকানো কী সম্ভব?
উত্তরে ইয়েচুরি বলেন, “মেরুকরণের রাজনীতির মোকাবিলা করতে মানুষের সমস্যা ও ইস্যুতে দৃষ্টি দিতে হবে। সেই সঙ্গে মানুষকে বোঝাতে হবে যে এই মেরুকরণই তৃণমূল এবং বিজেপি’র গেম প্ল্যান, মানুষের সচেতনতায় এটা নিয়ে আসতে হবে। আপনারা দেখেছেন এভাবে মানুষের ইস্যু নিয়ে আন্দোলন যেখানে গড়ে তোলা গেছে, সেখানে উপনির্বাচনে এর ফলাফল ভালো হয়েছে। বিজেপি’কে তৃতীয় স্থানে নামিয়ে আনা গেছে বালিগঞ্জে। তার মানে দেখা যাচ্ছে, এটা করা সম্ভব। অর্থাৎ এই মেরুকরণ ভাঙার সম্ভাবনা রয়েছে বাংলার শ্রমজীবী জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক শক্তিশালী করার মধ্যে। বাংলায় এই সংযোগের বিরাট ঐতিহ্য রয়েছে, সেটা পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। পুরানো স্লোগানে হবে না, আজকের বাস্তবতার ওপরে দাঁড়িয়ে করতে হবে আগামী দিনের জন্য। সবচেয়ে বড় কথা, বিজেপি বনাম কোনও দলের মেরুকরণ মানেই কিন্তু হিন্দুত্বের আক্রমণকে পরাস্ত করা নয়। এটা বহু রাজ্যে প্রমাণিত। নিজেদের বিজেপি বিরোধী হিসাবে দেখিয়ে যাত্রা শুরু করে সেই বিরোধীরা পরবর্তীতে ভেঙে চুরমার হয়ে মিলিয়ে গেছে এবং প্রকৃতপক্ষে বিজেপি’রই লাভ হয়েছে এমন নজির আছে। যে পদ্ধতিতে তারা মানুষের কাছে নিজেদের বিজেপি বিরোধিতা দেখাচ্ছে সেই পদ্ধতি আসলে বিজেপি’কেই শক্তিশালী করছে। অগণতান্ত্রিক পদ্ধতি, ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানো, প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতা এসবই বিজেপি’কে শক্তিশালী করছে।” তবে এখানেই ইয়েচুরিরর বক্তব্য নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, উনি বালিগঞ্জের প্রসঙ্গ টেনে নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা ফিরে পাওয়ার তত্ত্ব খাড়া করতে চাইলেন, কিন্তু ওই একই সময়ে আসানসোলে বাম প্রার্থীর দুরবস্থার ছবি তুলে ধরলেন না কেন? যেখানে বালিগঞ্জে দ্বিতীয় আর আসানসোলে ধপাস, বালিগঞ্জে যদি সিপিএম প্রাসঙ্গিকতা ফিরে পায়, তাহলে আসানসোল নিয়ে কী বলবেন?
সাক্ষাৎকারের একটি অংশে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের বিজেপি বিরোধিতাকে খাটো করে দেখানোর চেষ্টা করেন সিপিএমের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। ইয়েচুরির কথায়, “বাংলার মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী রামনবমীর দিনে কী করেছেন? তৃণমূলের আহ্বান কী ছিল? দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী হনুমানজয়ন্তীর দিনে হনুমান চালিশা পড়ে কী বার্তা দিয়েছেন? তাঁরা দেখাচ্ছেন বিরোধিতা করছেন, কিন্তু এই বিরোধিতা বাস্তবে বিজেপি’কে শক্তিশালী করছে, এটাই আমাদের অভিজ্ঞতা। তৃণমূল নিজেদের বিজেপি বিরোধী বলে দাবি করতে পারে, নির্বাচনে কিছু আসনে ওদের পরাজিতও করতে পারে। কিন্তু যে পদ্ধতি ও ইস্যু ওরা ব্যবহার করছে তাতে বাস্তবে বিজেপি’ই শক্তিশালী হচ্ছে। বামপন্থীরাই একমাত্র বিকল্প, বামপন্থীদেরই শক্তিশালী করতে হবে বাংলার উজ্জ্বল ঐতিহ্য ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য।”
ইয়েচুরির এমন যুক্তিতে অবশ্য ঘোড়াতেও হাসছে। একুশের বিধানসভা নির্বাচনে তাঁর দল সিপিএম-কংগ্রেস হাতমিলিয়ে শূন্য হয়েছে। এবং সেই নির্বাচনে বিজেপিকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার জন্য বামেদের ভূমিকা কী ছিল, বা সিপিএম বিজেপির হয়ে দালালিকে যে উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল, এই সাক্ষাৎকারের সময় তা সম্ভবত স্মরণে ছিল না সীতারাম ইয়েচুরির। সব মিলিয়ে দলীয় মুখপত্রে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বামেদের ভবিষ্যত নিয়ে দিশা দিতে ব্যর্থ সিপিএমের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক।