আশ্চর্য সলিল সঙ্গীত, উৎপল সিনহার কলম

0
2
উৎপল সিনহা

সঙ্গীতের মহাপ্রতিভা সলিল চৌধুরীকে নিয়ে হাজার হাজার পৃষ্ঠা লেখা হয়ে গেছে। কিন্তু, তাঁকে মেপে ওঠা, তাঁর বহুমুখী প্রতিভার যথার্থ মূল‍্যায়ণ আজও সম্ভব হয়ে ওঠে নি। কেননা, সত‍্যিই তিনি সাগরসম, বিরলের মধ‍্যে বিরলতর। সলিল-সঙ্গীতের সর্বোত্তম বৈশিষ্ট্য হল অপূর্ব অনিশ্চয়তা। সুরে ও ছন্দে ক্ষণে ক্ষণে অপ্রত‍্যাশিতের আগমন। প্রতি মুহূর্তে শ্রোতাদের হাত ধরে সুরপথের সম্পূর্ণ নতুন কোনো বাঁকে, অচেনা অজানা আশ্চর্য কোনো মোড়ে পৌঁছে সকলকে অবাক করে দেওয়ার মন্ত্রই ওঁর গানের মূল সম্পদ। সুরের জাল বুনতে বুনতে মগ্ন তন্ময় এই শিল্পী কখন যেন নিজেই জড়িয়ে পড়েন সেই জটিল ফাঁসে বারবার, আর তাঁর গুণমুগ্ধ শ্রোতারা যখন উদ্বিগ্ন হয়ে ভাবতে থাকেন, এই রে, এবার কী হবে, উনি এই জটিল জাল থেকে নিজেকে মুক্ত করবেন কীভাবে, ঠিক তখনই প্রায় জাদুকরের ক্ষিপ্রতায় সেই সুরজাল ছিন্ন করে বেরিয়ে এসে তাঁর শ্রোতাদের নিশ্চিন্ত করেন স্রষ্টা সলিল। শ্রোতারা যথারীতি মুগ্ধ ও বিস্মিত হন ও আনন্দপ্লাবনে ভেসে যান।

তাঁর গানে আরেকটি অতি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করতে হয়। তা হল, আনন্দের মোড়কে জীবনযন্ত্রণা ও সংগ্রাম পরিবেশন। আসলে, তিনি মানুষের দুঃখ, দারিদ্র, নিপীড়ন ও অসহায়তা দেখেছেন তাঁর শৈশব থেকেই। তাঁদেরই দুঃখ বেদনা ও জীবন সংগ্রাম তাঁর গানের বাণী হয়ে ফুটে উঠেছে, কিন্তু, সুরের ক্ষেত্রে তিনি সবসময় লক্ষ্য রেখেছেন যেন গানগুলির মধ‍্যে আনন্দের উপাদান থাকে যথেষ্ট, নইলে মানুষ সেই গান গাইবে কেন, শুনবেই বা কেন? তাই তিনি এত সফল স্রষ্টা এবং তাঁর গানগুলি এত জনপ্রিয়। আর, তাঁর অবিস্মরণীয় অর্কেস্ট্রেশন? সঙ্গীতায়োজন? ভারতীয় সঙ্গীতব‍্যক্তিত্বদের একটা বড়ো অংশই তো একথা স্বীকার করেন যে, এই ব‍্যাপারটিতে গোটা দেশে তিনি অদ্বিতীয় তো অবশ‍্যই, এমনকি যে সমস্ত পাশ্চাত্য গুরুস্থানীয় সঙ্গীতপ্রতিভাদের দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত ছিলেন তিনি, অনেক সময় তাঁদেরও ছাপিয়ে গেছেন!
সলিল চৌধুরীকে নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে নতুন ঘরানার সঙ্গীতচিন্তক। তাঁর অনন‍্যসাধারণ প্রতিভার বিচ্ছুরণ ভারতীয় সঙ্গীতকে সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর করেছে। প্রাচ‍্য ও পাশ্চাত্য সঙ্গীতের মিশ্রণে এমন কিছু আশ্চর্য গান তিনি সৃষ্টি করে গেছেন বাংলা ও হিন্দি-সহ আরও ১১টি ভাষায়, যা তাঁকে বিশিষ্ট করে রেখেছে।
তিনি ভারতীয় সঙ্গীতের এক বর্ণময় চরিত্র। সঙ্গীতের প্রথাগত, প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত শৈলীগুলো থেকে বেরিয়ে সম্পূর্ণ নতুন এক শৈলীর জন্ম দিয়েছেন তিনি, যাকে সলিল শৈলী বা সলিল ঘরানা বললে অবশ্যই অত‍্যুক্তি হবে না।

কর্ড প্রয়োগে তিনি সেবাস্টিয়ান বাখ্-এর উত্তরসূরী। বিটোফেন ও মোৎসার্ট- এর সিম্ফনি তাঁর মুখে মুখে ঘুরতো। তিন বা ততোধিক নোট একসঙ্গে ব‍্যবহার ক’রে যে অপরূপ মাধুর্যমন্ডিত স্বরসঙ্গতি বা সুরতরঙ্গ তিনি সৃষ্টি করে গেছেন তা ভারতীয় সঙ্গীতে তো বটেই, এমনকি পাশ্চাত্য সঙ্গীতেও খুব বেশি পাওয়া যায় না।
বিটোফেনের নানা সিম্ফনি, মোৎসার্টের জি-মাইনর ফর্টিয়েথ সিম্ফনি ও জি-মাইনর কর্ডের প্রতি তাঁর অনুরাগ থেকে তিনি তাঁর অনেক গানে সেইসব সঙ্গীতসম্পদ প্রয়োগ করেছেন । ‘ ছায়া ‘ চলচ্চিত্রে ‘ ইতনা না মুঝে তু প‍্যার বঢ়া’ গানটি মোৎসার্টের সিম্ফনির ছায়ায় রচিত। ‘ অন্নদাতা ‘ ছবিতে শ‍্যঁপ‍্যা-র সৃষ্টির ছায়ায় নির্মিত ‘রাতো কি সায়ে ‘ ভারতীয় সঙ্গীতে অমর হয়ে আছে।

আরও পড়ুন- Pururlia: কংগ্রেস কাউন্সিলর খুনে দিনভর ম্যারাথন জেরার পরে ধৃত দাদা