
খাদ্য, বাসস্থান এবং অবশ্যই পছন্দের নারীর জন্য গুপ্তচরবৃত্তি সম্ভবত সেই গুহামানবের কাল থেকেই। অন্যকে টেক্কা দিতে আড়ি পেতে প্রতিপক্ষের দুর্বলতা এবং পরিকল্পনার আঁচ করাই হল গুপ্তচরবৃত্তি। সময়ের সাথে সাথে গুপ্তচরবৃত্তির উদ্দ্যেশ এবং পদ্ধতির রকমফের ঘটেছে তবে যুগে যুগে প্রাচীন ভারত থেকে চিন, গ্রীস, মিশর-পারস্য-মেসোপটেমিয়া-সিরিয়া-আরব দেশ ঘুরে বর্তমানের ইজরায়েল পর্যন্ত গুপ্তচরবৃত্তির ইতিহাস লম্বাই। ওল্ড টেস্টামেন্টে উল্লেখ রয়েছে ইজরায়েলের যোশুয়া আনুমানিক ১৩০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে ডেড সি উত্তরে জর্ডনের জেরিকো প্রদেশ দখল করতে গুপ্তচরদের সাহায্য নিয়েছিল। অধুনা আইটি-র ট্রোজান ভাইরাস হোমারের ইলিয়ডে আক্রমণাত্মক গুপ্তচরবৃত্তির নিদর্শন ট্রোজান হর্স থেকে ধার করা। ইলিয়ডে আছে ডোলন নামের ট্রয়ের এক গুপ্তচর আর্গোসের রাজা ডায়োমিডিসের হাতে মৃত্যু বরন করে। ইথাকার রাজা ওডেসিউসের ট্রয় যুদ্ধ শেষে সমুদ্রযাত্রা নিয়ে রচিত গ্রীক মহাকাব্য ওডিসিতে গ্রীকদের শত্রুদেশ থ্রেসদেশের শিবিরে ইথাকার চর পাঠানোর উল্লেখ রয়েছে।
আরও পড়ুন-বিজেপি’র জয়প্রকাশকে বৃহস্পতিবার পুলিশের কাছে যেতে নির্দেশ হাইকোর্টের
বাইবেল, ইলিয়াড-ওডিসি ছাড়াও আমাদের নিজস্ব রামায়ন-মহাভারতে গুপ্তচরবৃত্তির উল্লেখ রয়েছে। রাবনের চর খর এবং দূষণ জম্বুদ্বীপে চরবৃত্তি করত, তাছাড়াও নাক-কান কেটে নেওয়াতে যেমন চর শূর্পণখার নাম জড়িয়ে গেছে তেমনই মারীচের নাম জড়িয়ে রয়েছে সোনার হরিণ কান্ডে। মহাভারতে পাণ্ডবেরা বারানবতের জতুগৃহে পৌঁছালে বিদুর কৌরবদের চক্রান্ত গুপ্তচর মারফত খবর পেয়ে পাণ্ডবদের অ্যালার্ট করে দেন, সে যাত্রায় বেঁচে যায় পাণ্ডবেরা। সুদূর গ্রীস থেকে অ্যালেকজান্ডার পরম বিক্রমে পারস্য সম্রাটকে হারিয়ে ভারতে এসে পৌঁছেছিলেন তাতে তাঁর গুপ্তচরদের অবদান অনস্বীকার্য।
সামরিক শক্তির আঁচ পেতে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ছদ্মবেশে গ্রীক সৈন্যশিবিরে যেমন ঢুকেছিলেন আবার মৌর্য সাম্রাজ্য যার কূটবুদ্ধি ছাড়া স্থাপিত হতই না সেই চানক্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে পঞ্চসংস্থা গুপ্তচরচক্রের অবশ্যম্ভাবী প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছেন। প্রাচীন চিন দেশের গুপ্তচররা ‘রহস্যময় তন্তু’-র আকারে দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে থাকত আর আজকে তারা হান জুন্যের রুপে।
বৃহত্তর আরবের মধ্যযুগীয় ইতিহাস খুবই জটিল। জটিল এই ইতিহাসের পাতায় পাতায় চরম অবিশ্বাসের সঙ্গেই গুপ্তচরদের বাড়বাড়ন্ত। গুপ্তচরদের দৌলতেই বিশ্বাসঘাতকতা আর গুপ্তহত্যা, গোপনে খাবারে বা পানীয়ে বিষ মিশিয়ে হত্যা, কথায় কথায় যুদ্ধ আর শিরচ্ছেদ ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার স্যাপার। ইরাকের শহর কুফার মসজিদে নামাজ পড়ার সময় মাবিয়ার চক্রান্তে গুপ্তচর ইবন মুলজাম ৬৬১ সালের ২৬শে জানুয়ারী হজরত আলীর পিঠে বসিয়ে দিয়েছিল বিষ মাখান ছুরি।
ইতিহাসে রয়েছে মাবিয়ার পুত্র এজিদ কেমনভাবে বৃদ্ধা ময়মুনার মাধ্যমে হজরত হাসানের দ্বিতীয় স্ত্রী জায়েদাকে নানান প্রলোভন দেখিয়ে বিভ্রান্ত করে প্ররোচিত করে বিষ প্রয়োগে হাসানকে হত্যা করতে। তৃতীয় বারের চেষ্টায় জায়েদা সক্ষম হয় পানীয়-জলের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে হাসানের মৃত্যু ঘটাতে।
রোম সাম্রাজ্যের পতনের পর বাইজান্টাইন সম্রাট শারলামেন সমগ্র ইউরোপ এবং পশ্চিম এশিয়া জুড়ে ‘মিসি’ নামের শক্তিশালী চরচক্রের মাধ্যমে রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক খবরাখবর নিতেন। পরবর্তীকালে মহম্মদ ঘোরী ভারতের মুখ্যদ্বারপাল পৃথ্বীরাজ চৌহানকে ব্যাগে আনতে বিশ্বাসঘাতক জয়চাঁদের সাহায্য ছাড়াও গুপ্তচরদের সাহায্য নিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন-নেতাজির ”মৃত্যুবার্ষিকী” নিয়ে টুইট বিজেপি-কংগ্রেসের! “আবেগ নিয়ে খেলবেন না” পাল্টা কুণালের
মধ্যযুগে ইসলামি শাসনকালে মুঘল এবং পাঠানদের রাজত্বের সময় গুপ্তচরবৃত্তি ছিল প্রশাসনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। গুপ্তচরদের মাধ্যমে খবর জোগাড় করে বেইমানদের কিংবা বিদ্রোহীদের শিরচ্ছেদ ছিল তখনকার সময়ে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। ইরাংজ আমলে স্বাধীনতাকামী ভারতীয়দের বিদ্রোহ প্রতিহত করতে ডিভাইড এন্ড রুল ছাড়াও শক্তিশালী চরবৃত্তির উপর গুরুত্বের ভুরি ভুরি উদাহরন রয়েছে। প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অক্ষশক্তি এবং মিত্রপক্ষের মধ্যে গুপ্তচরবৃত্তি শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছায়, সামরিক কর্তাদের উপর নারীশক্তির প্রয়োগ থেকে স্পাই ইত্যাদি ছাড়াও দূরভাষ এবং চিঠি ইন্টারসেপশনের মাধ্যমে প্রতিপক্ষের স্ট্রাটেজি জেনে নেওয়া ছিল কৌশলের অঙ্গ। আমাদের চেনাশোনার মধ্যে ডাচ নর্তকী মাতা হারিকে ফ্রান্স গুপ্তচরবৃত্তিতে নিয়োগ করলেও জার্মানির হয়ে ডাবল এজেন্টের কাজ করছিল মাতা হারি ওরফে মার্গারিটা তাই ধরা পড়ে পারিসের বাইরে তাকে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়াতে হয়। আধুনিক বিশ্ব যাকে পয়লা নম্বরের গুপ্তচরের তকমা দিয়েছে সে হল আমেরিকার সি আই এ এজেন্ট অলড্রিচ হ্যাজেন এইমেজ, দীর্ঘদিন সুনামের সঙ্গে কাজ করার পর রাশিয়ার কে জি বি-র ডবল এজেন্ট হিসাবে ধরা পড়ে যাবজ্জীবন কারাদন্ড ভোগ করে। মজার বিষয় হল সাহস, বুদ্ধিমত্তা, দেশপ্রেম এবং চূড়ান্ত ত্যাগের পরিচয় দিলেও ধরা পড়লে গুপ্তচরদের মৃত্যু হয় সকলের অজ্ঞাতে আড়ম্বরহীনভাবে।
বছর পঞ্চাশ আগের বড়সড় স্ক্যাম ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির কথা নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে কিংবা শুনেছি। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের প্রশাসনের কর্তাব্যাক্তিরা অবৈধভাবে বিরোধীদের উপর বাগিং থেকে শুরু করে নানানভাবে প্যাঁচে ফেলার চেষ্টা করে ইন্টারনেল রেভিন্যু সার্ভিসকে হাতিয়ার করে। প্রেসিডেন্ট ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করলে হাউস অফ কমেন্স প্রেসিডেন্ট নিক্সনের বিরুদ্ধে ইম্পিচমেন্ট প্রস্তাব আনে, বাধ্য হয়ে নিক্সন ৯ই আগস্ট ১৯৭৪ পদত্যাগ করেন।
আরও পড়ুন-ত্রিপুরায় “তালিবানি বিপ্লব”, হোটেলে সায়িনীর রুমে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন
বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে অন্তর্জাল উত্তর যুগ যেমন পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে তেমনই হাট করে খুলে দিয়েছে সাধারন থেকে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ন মানুষের প্রাইভেসি। গেজেটের ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কমেছে গুপ্তচরবৃত্তিতে মানুষ-এজেন্টের ব্যবহার, সে ওভার্ট গোয়েন্দাগিরি হোক আর কোভার্ট চরবৃত্তি। তবুও আমেরিকার সি আই এ কিংবা এফ বি আই, রাশিয়ার কে জি বি, পাকিস্তানের আই এস আই, ভারতবর্ষের ‘র’, ব্রিটিশদের এম আই-৬ কিংবা ইজরায়েলের মোসাড পৃথিবীজুড়ে গোপন মডিউলের মাধ্যমে তাদের জাল বিস্তার করে রেখেছে। ক্লাসিফায়েড ডকুমেন্টের দায়িত্বে থাকা কর্তা এবং সামরিক অফিসারদের হানি-ট্র্যাপের প্যাঁচে ফেলে গোপন তথ্য হাতিয়ে নেওয়া কিংবা নগদ কাঞ্চনের প্রলোভনের মাধ্যমেও বহু জটিল কাজ সহজে তামাম হয়েছে, তার সামান্য কিছু ল্যাপস্ ফাঁস হয়ে মাঝেমধ্যে সাধারন নাগরিকের গোচরে আসে। এই সমস্ত গুপ্তচর সংস্থা তাদের কাজ দ্রুত এবং নিখুঁতভাবে করবার জন্য বহু আধুনিক ইলেকট্রনিক গ্যাজেটের সাহায্য নেবে তাতে কোন সন্দেহ থাকার কথা নয়।
সন্দেহজনক ব্যক্তির বাড়ি কিংবা অফিসে, গোপন জায়গায় কিংবা মদের আড্ডায় আড়ি পেতে মিটিং কিংবা নিছক গল্পগাছার খবর সংগ্রহ করতে তদন্তকারি সংস্থাগুলো এজেন্ট (সোর্স) ঢুকিয়ে কিংবা বাগিং ডিভাইস প্লেস করে কখনওবা গোপন ক্যামেরা ব্যবহার করে থাকে, তার প্রয়োজনীয়তাও যেমন অপরিসীম তেমনই গোপন জি পি এস ব্যবহারের মাধ্যমে কারো মুভমেন্ট ট্র্যাক করার মধ্যেও কিছু আনএথিকেল ব্যাপার স্যাপার থাকলেও প্রয়োজনের তাগিদেই গোয়েন্দাদের এসব আকচার করতেই হয়!
এই সমস্ত আড়িপাতা কিংবা গুপ্তচরবৃত্তিকে একশ হাত পিছনে ফেলে দিয়েছে আধুনিকতম স্পাই ইজরায়েলের এন এস ও (নিভ, শালেভ এবং ওমরি –কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতাদের আদ্য নাম) সৃষ্টি পাখনাওয়ালা উড়ন্ত ঘোড়া – ট্রোজান হর্স বা পেগাসাস। বিশ্বজুড়ে তাবড় রাজনীতিবিদ, গুপ্তচর সংস্থা, ধনকুবের, আধিকারিক, সাংবাদিক, সমাজকর্মী থেকে শুরু করে মানধিকার কর্মীদের ঘুম কেড়ে নেওয়া এই স্পাইওয়্যার যা স্মার্টফোনের মাধ্যমে ‘রিমোট সারভিলেন্সে’ সিদ্ধহস্ত। কিছুদিন আগেও অ্যাপের সাহায্যে ছদ্মবেশে কোন ম্যালওয়ার ফোনে ঢোকাতে গেলে গ্রাহকের অনুমতির প্রয়োজন হত কিংবা ক্লিক করতে হত ওয়েবপেজ খুলতে কখনও ডাউনলোড করতে হত কোন অ্যাপ কিংবা লিঙ্ক কিন্তু পেগাসাস অনুমতির ধার ধারে না, এক্কেবারে জিরো ক্লিক পেলোড, একেবারে অজান্তে এবং নিঃশব্দে ঢুকে আসে আপনার গেজেটে। সবচাইতে মজার ব্যপার হল ভগবানের মত এর উপস্থিতি টের পাওয়া যায় না, আপনার গেজেটে ঢুকতে পারে নিঃশব্দে আবার ছেড়েও যায় নিঃশব্দে, কোন পদচিহ্ন ছাড়াই। ‘কব সে হুঁ রেডি তৈয়ার, পটালে সইয়াঁ মিস্ কল সে’ আধুনিক গেজেট ‘তৈয়ার’ হয়েই রয়েছে পেগাসাসের ভাইরাসকে আহ্বান জানাতে সে মিস কল হোক কিংবা ফেক ওয়েবসাইট, অ্যাপ, ইমেল কিংবা যে কোন ম্যালওয়্যারের মাধ্যমে। তাই একবার কেউ আপনাকে টার্গেট করলে নিস্তার নেই ভাইরাস এই স্পাইয়ের হাত থেকে।
আরও পড়ুন-ত্রিপুরা: খাবার স্বাধীনতা, বিদ্যুৎ বিভ্রাট, প্রতিহিংসার রাজনীতি! স্বৈরাচারী শাসককে তোপ সায়নীর
পেগাসাস স্পাইওয়ারের সাহায্যে হাজার হাজার মাইল দূর থেকে ভাইরাস ঢুকিয়ে মোবাইল, ট্যাব, ল্যাপটপ কিংবা কম্পিউটার থেকে যাবতীয় তথ্য হাতিয়ে নিয়ে সারভারে জমিয়ে রেখে ইচ্ছেমত ব্যবহার করা যায়। পেগাসাসের ভিক্টিম অ্যানড্রয়েড, অ্যাপেল ১৪.৬ ভার্সান আই ফোন থেকে সব্বাই, যত আধুনিক গেজেট তত বেশী পছন্দ পেগাসাসের, সিস্টেমের মধ্যে ঢুকে গেজেটের সার্কিট এবং প্রসেসারকে কব্জা করা। আপনার যাবতীয় জমানো তথ্য থেকে শুরু করে মাইক্রোফোন, ক্যামেরার মাধ্যমে পারিপার্শ্বিক ঘটতে থাকা ঘটনাবলী থেকে হোয়াটসঅ্যাপ, সিগন্যাল, ফেসটাইম, টুইটার, ইমেল, ফেসবুক সবকিছু কব্জা করে নেয় চোখের পলকে তা যতই হোয়াটসঅ্যাপ লিখুক না কেন এন্ড টু এন্ড এনক্রিপটেড, এনক্রিপশনের আগেই আপনার ডাটা জমা পড়বে পেগাসাসের সারভারে।
২০১৬ সালে পেগাসাস বাজারে পৌঁছে যাওয়ার খবর থাকলেও ২০১৯ শে ভারতবর্ষে প্রথম এর উপস্থিতি টের পায় হোয়াটসঅ্যাপ, প্রায় হাজারখানেক ফোন ততদিনে হ্যাক করা হয়েছে, তারমধ্যে তাবড় সব নাম। এই তথ্য জানার পর হোয়াটসঅ্যাপ ইজরায়েলের এন এস ও গ্রুপের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে। কার কার ফোনে পেগাসাস ভাইরাস ঢুকিয়ে তাদের যাবতীয় তথ্য কাদের অঙ্গুলিহেলনে হাতান হয়েছে তা আমরা এতদিনে সংবাদ মাধ্যমের সহায়তায় জেনেছি। সুপ্রিম কোর্টের মহিলা কর্মচারি যিনি তদানিন্তন চীফ জাস্টিসের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ এনেছিলেন তার ফোনে যেমন পেগাসাস ভাইরাস ঢুকিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তেমনই ওয়াশিংটন পোষ্টের জার্নালিষ্ট জামাল খাসোগি, যিনি একাধারে সৌদি আরবের মানবধিকার কর্মীও ছিলেন এবং ২রা অক্টোবর ২০১৮ সালে ইস্তানবুলে সৌদি আরবের ক্যন্সুলেটে খুন হয়ে যান, তার ফোনেও পেগাসাস ভাইরাস ঢুকিয়ে তার সমস্ত ডাটা চুরি করার অভিযোগ রয়েছে। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমান্যুয়েল মাঁকর থেকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের মোবাইল ফোনে পেগাসাস ভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে, তাই পেগাসাসের কর্ম-পরিধি সহজেই অনুমেয়।
এজেন্টের মাধ্যমে এন এস ও-র আধিকারিকরা ঘুর ঘুর করে বিভিন্ন তদন্তকারি সংস্থার কর্তাব্যক্তিদের আশেপাশে হয়তোবা বড় বড় কর্পোরেট কোম্পানি গুলোর কাছেও। মাত্র ৫৫ থেকে ৬০ কোটি টাকা খসালেই খোদ ইজরায়েল থেকে এন এস ও-র লোকেরা এসে প্রোগ্রামিং করে হাতে হাতে পৌঁছে দেবে কাঙ্খিত ল্যাপটপ। পছন্দমত টার্গেটে স্পাই ভাইরাস ছড়িয়ে দেওয়া হাতের মুঠোয়। তার আগে অবশ্য নির্দিষ্ট আই পি (ইন্টারনেট প্রোটকল) নম্বর নিতে হবে, কিনতে নয়তো ভাড়া করতে হবে সারভার, চুরি করা ডাটা স্টোর করতে হবে না!
এই স্পাইদের কি ব্লক করা যায় না? এখনও খুব বেশী কিছু জানা নেই পেগাসাস অ্যান্টি-ভাইরাস সম্বদ্ধে তবে শোনা যায় আমেরিকার সাইবার বিশেষজ্ঞরা এর মধ্যেই জেড-কপ বানিয়ে ফেলেছে তাদের ভি আই পি দের গোপন খবর সুরক্ষিত রাখতে! আমরা থাকি আমাদের সরকারের দয়ার উপর। মোবাইল বা অন্যান্য গেজেট সাইবার এক্সপার্টদের মাধ্যমে মোবাইল ভেরিফিকাশন টুল দিয়ে স্ক্যান করানো যায় চতুর এই ভাইরাসকে খুঁজে পেতে। তবে ফোনের সেট বদলালে আবার নতুন করে ভাইরাস না ঢোকালে আপনি সেফ। ভাইরাস খুঁজে পেলেও জো নেই কে পাঠিয়েছে তাকে খুঁজে বার করবার! তাই আইনি ব্যবস্থা নিলে কার বিরুদ্ধে নিতে হবে এইসব প্রশ্নের উত্তর নেই।
উত্তর তো নেই কিন্তু আইন কি রয়েছে? কেন্দ্রীয় কিংবা রাজ্য সরকার চাইলে দেশের নিরাপত্তার পক্ষে ক্ষতিকারক, টেররিস্ট, অন্তর্ঘাতের সঙ্গে জড়িত সন্দেহজনক কিংবা ডেঞ্জারাস কোন ক্রিমিন্যালদের ক্ষেত্রে ‘জায়েজ’ বা লিগ্যাল ইন্টারসেপশান নিতেই পারে, আইনও রয়েছে ইন্ডিয়ান পোষ্ট অ্যান্ড টেলিগ্রাফ অ্যাক্ট, ১৮৮৫ -র ৫ নম্বর ধারায়। সে ইমেল হোক কিংবা ফোন-মোবাইল ফোন। কেন্দ্রে এবং রাজ্যে এই ইন্টারসেপশনের হুকুম দেওয়ার নোডাল অফিসারও নির্দিষ্ট করা রয়েছে। ফোনে আড়ি পেতে ষড়যন্ত্র থেকে পরিকল্পনা শুনতেই পারে সরকারি তদন্তকারী কোন সংস্থা। আই বি, সি বি আই, ই ডি, সি আই ডি কিংবা পুলিশ গুরুত্বপূর্ন কেসের তদন্তের স্বার্থে কিংবা মেজর কোন ক্রাইম প্রিভেনশনের জন্য ল্যান্ডলাইন কিংবা মোবাইল ফোন ট্যাপিং করে থাকে এটা আজ আর বোধহয় কারো অজানা নয়! এছাড়াও রয়েছে অফ এয়ার ইন্টারসেপশন, মূলত তিন ধরনের ডিভাইস রয়েছে, কার মাউন্টেড, ব্যাক-প্যাক ক্যারেড এবং হ্যান্ড-হেল্ড মেশিনের মাধ্যমে মোটামুটিভাবে দেড় থেকে দুই স্কোয়ার কিলোমিটার এরিয়ার মধ্যে যেকোন সন্দেহজনক ফোন কিংবা ইলেকট্রনিক গেজেটকে অত্যন্ত জরুরি ভিত্তিতে ইন্টারসেপ্ট করা হয়ে থাকে। ষড়যন্ত্র, অনর্ঘাত কিংবা ক্রাইম সংক্রান্ত তথ্যের ফাঁকে ব্যক্তিগত কিছু তথ্য জানা গেলেও তা নিয়ে কোন তদন্তকারী সংস্থা তার অপপ্রয়োগ করে না বরং ক্রাইম সংক্রান্ত ব্যাপারেই তদন্ত সীমাবদ্ধ রাখে। চিরাচরিতভাবে এমনটাই চলে আসছে, এটাই কনভেনশন আর এটাই এথিকস্।
আরও পড়ুন-তালিবানি দখলে জঙ্গলের দুনিয়ায় পরিণত আফগানিস্তান, দেশে ফিরলেন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত
তদন্তকারী সংস্থা পারে আইনসম্মতভাবে কোন নাগরিকের বাড়ি রেইড করে সব সন্দেহজনক সম্পত্তি সিজ করে নিতে পারে তার বিরুদ্ধে কেস কিংবা সার্চ-ওয়ারেন্ট ইত্যাদি থাকলে কিন্তু সরকার বাহাদুরও পারে না ঘরে চোর ঢুকিয়ে কোন নাগরিকের জিনিসপত্র চুরি করিয়ে নিতে কিংবা গোপন তথ্য হাতিয়ে নিতে, এটা কিন্তু হ্যাকিং এবং ‘নাজায়েজ’। ভারতীয় সংবিধানের আর্টিক্যাল ১৯ শে নাগরিকের বিভিন্ন মৌলিক অধিকার রয়েছে, প্রাইভেসি প্রোটেকশনের অধিকার রয়েছে আর্টিক্যাল ২১ সে যতই পাবলিক অর্ডার কিংবা ন্যাশনাল সিকিউরিটির বাহানা দিক সরকার, নাগরিকের মৌলিক অধিকার খর্ব করতে পারে না সরকারও। গোপনে আপনার মৌলিক অধিকার এবং প্রাইভেসি বিনষ্ট করার জন্য কোন শাস্তির প্রভিশন কি নেই? আছে, ইন্ডিয়ান পোষ্ট এন্ড টেলিগ্রাফ অ্যাক্ট ১৮৮৫- র ৫ নম্বর ধারা ছাড়াও ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যাক্ট ২০০৮ এর ধারা ৪৩, ৪৩ এ, ৭২ এবং ৭২ এ ব্যবস্থা রয়েছে শাস্তির তবে সবটাই নির্ভর করছে সরকারের সদিচ্ছার উপর! কানাই পন্ডিত তাই টিকি নেড়ে পড়াতেন ‘কুপুত্র যদ্যপি হয় কুমাতা কদাপি নয়’। আপনার মৌলিক অধিকার ততখানি সুরক্ষিত যতটা ভাল আপনার সরকার। সন্তান খারাপ হলে মায়েরা সন্তানদের শাসন করে এসেছে যুগে যুগে তবে মা যদি সন্তানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে? তাহলে সে কৈকেয়ী, নেহাতই সৎমা!
এন এস ও অবশ্য দাবি করে তাদের এই স্পাইওয়ারের মাধ্যমে বহু টেররিষ্ট অ্যাকটিভিটি এবং অন্তর্ঘাত অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়েছে, দেশ বেঁচে গেছে অনেক অপ্রয়োজনীয় যুদ্ধের হাত থেকে, অনেক প্লেন হাইজ্যাক হওয়া থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছে, বহু টেররিষ্টকে পাকড়াও করা কিংবা নিউট্রালাইজ করা সম্ভব হয়েছে, আগেভাগে অনেক মেজর ক্রাইম আটকানো গেছে। এর সবটা মিথ্যা নয় তবে কিনা পেগাসাস এমন একটা ভাইরাস যার হাতে তার ‘নিয়তের’ উপর নির্ভর করছে অনেক কিছুই, ভাল কাজে নাকি কু-কাজে-কু-উদ্দেশ্যে লাগাবে এই ভাইরাস!
এখনকার ডেফিনিশনের গনতান্ত্রিক ভারতবর্ষের নাগরিক সরকারের কাছে দুধের শিশু বইত নয়, মা মুখে দুধ দেবে নাকি বিষ সে কেবল মা-ই ঠিক করতে পারে! সাধারন নাগরিক শুধু বলতে পারে, বাবুজি গনতন্ত্র শুধু সর্ববৃহৎ নয় ‘বড়ি হোনি চাহিয়ে’!!