রামচন্দ্রই বাংলায় ডুবিয়ে দিয়েছেন বিজেপিকে৷ বিস্তর হাঁকডাক করে ৭৭ আসনে এসে ডবল-ইঞ্জিন বিকল হয়ে যাওয়ার প্রধান কারন ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান ৷ কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা এমন বিস্ফোরক রিপোর্টই পেশ করলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে৷ এর ফলে, বাংলায় পরাজয়ের দায় এড়ানোর পথ বন্ধ হয়ে গেলো মোদি-শাহের৷ কারণ এই দু’জনের সরাসরি নেতৃত্বেই বাংলায় ভোট করেছে বিজেপি৷ এখন পরাজয়ের দায়ও ওই দু’জনকেই নিতে হবে, এমনই বলছে রাজনৈতিক মহল তথা বঙ্গ-বিজেপির একাংশ৷ দিল্লির গেরুয়া নেতাদের আওয়াজ ছিলো ২০০ আসনের৷ ২মে ফলপ্রকাশের পর দেখা গেলো সেই আওয়াজ চুপসে ৭৭-এ এসে ঠেকেছে৷ সেই মুহুর্ত থেকেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করে, তাহলে কী মোদি-শাহ ভোটের হাল-হকিকৎ কিছুই বোঝেন না ? এই পরাজয় এখনও যে মেনে নিতে পারেননি প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তা ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে রাজ্যের প্রতি কেন্দ্রের বেশ কিছু অস্বাভাবিক ব্যবহারে৷
কিছুদিন আগে অমিত শাহ নিজেই, তাঁর অধীনস্থ গোয়েন্দা দফতরকে নির্দেশ দেন, বাংলায় এভাবে পরাজয়ের কারণ খুঁজে বার করতে৷ কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা ‘কাজে’ নেমে পড়েন৷ আর সম্প্রতি সেই রিপোর্টও তুলে দেওয়া হয়েছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের হাতে৷
সূত্রের খবর, ১২৮ পাতার ওই রিপোর্টের ছত্রে ছত্রে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতাদের কার্যকলাপ তথা নির্দেশ এবং বাংলার ভোট বোঝার অক্ষমতাকেই এই পরাজয়ের জন্য দায়ি করা হয়েছে৷ এই রিপোর্ট পেয়ে চক্ষু চড়কগাছ শাহের৷ কারণ, বাংলা ‘দখল’ করার গেরুয়া যুদ্ধে তিনিই ছিলেন প্রধান সেনাপতি৷ গোয়েন্দা রিপোর্টে উল্লেখ করা কারণসমূহ গ্রহণ করলে, প্রমান হবে বঙ্গ-ভোটে বিজেপির এই লজ্জাজনক পরাজয়ের অন্যতম প্রধান কারণ মোদি- শাহের বেশ কিছু সিদ্ধান্ত৷ এই সব সিদ্ধান্তই খাদের কিনারায় নিয়ে গিয়েছে বিজেপিকে৷ ফলে পরাজয়ের দায় এড়ানোর জায়গায় মোদি-শাহ আর নেই৷
গেরুয়া অন্দরের খবর, অমিত শাহের কাছে জমা পড়া কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের ওই রিপোর্টে বিজেপির হারের সম্ভাব্য কারণ নিয়ে পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। রিপোর্টে উঠে এসেছে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।একইসঙ্গে অসংখ্য সদ্যনির্বাচিত বিজেপি বিধায়ক আজ বা কাল তৃনমূলে যোগ দিতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে ওই গোয়েন্দা রিপোর্টে। নির্ভরযোগ্য সূত্রের খবর, ওই রিপোর্টে বাংলায় বিজেপির এভাবে মুখ থুবড়ে পড়ার কারণ হিসাবে এক নম্বরে রাখা হয়েছে রামচন্দ্রকেই৷
বলা হয়েছে,
◾বাংলার ভোটে বিজেপির শীর্ষ নেতা বা অন্যান্য নেতাদের মুখে মুড়ি-মুড়কির মতো ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগানই কাল হয়েছে বিজেপি’র৷ রিপোর্ট বলছে, ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি-ই পিছনে নিয়ে গিয়েছে বিজেপিকে৷ কারণ বাংলায় রামের পুজোর সেভাবে প্রচলনই নেই। ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনির ঢালাও ব্যবহার দেখে জনমানসে ভয় তেরি হয়েছিলো বিজেপি এলে ঘরে ঘরে রামপুজো করতে বাধ্য করা হবে৷ বিজেপি বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজোকে নিয়ে সেরকম ভাবে মাথা ঘামায়নি৷ এটাই ব্যুমেরাং হয়েছে৷
◾ গোয়েন্দা রিপোর্টে বলা হয়েছে দলবদল করা নেতাদের মাথায় তোলা ব্লাণ্ডার হয়েছে। দলবদল করে যারা বিজেপিতে এসেছে, তাদের মধ্যে অনেকেরই ভাবমূর্তি ভালো নয়। তাঁদের অনেকের বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। জনপ্রিয়তা তলানিতে ঠেকেছে বলেই এদের অধিকাংশই তেমন জনসমর্থনই পাননি। এই সব দলবদলু নেতাদের সাধারণ মানুষ মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। যার জেরে আছাড় খেয়েছে বিজেপি।
◾ বাংলায় ভোট প্রচারে নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহ ছাড়াও এসেছেন ডজন ডজন কেন্দ্রীয় নেতা। যোগী আদিত্যনাথ, শিবরাজ সিং চৌহান-সহ বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলির মুখ্যমন্ত্রীদের নিয়ে আসা হয়েছিলো। অন্য রাজ্যের এসব নেতাদের ভাষা-ই বাংলার মানুষ বোঝেনি৷ এনারা কী বলছেন, তা কতখানি ভালো, কতখানি উপকার করবে মানুষকে, তা বুঝতেই পারেননি বাংলার ৮০ শতাংশ ভোটার৷
◾ বঙ্গ-বিজেপির নেতাদের কাজকর্ম, কথাবার্তা, আচার-ব্যবহার নিয়েও নানা বিরূপ কথা রিপোর্টে বলা হয়েছে৷
রাজের বিজেপির ৩০ জন নেতার চালচলন নিয়ে মানুষের মনে প্রশ্ন ছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। জেলাস্তরের নেতাদের দুর্নীতি ও বিলাসবহুল জীবন এবং ব্যবহার মানুষ ভালো করে নেয়নি উল্লেখ করা হয়েছে৷ ওই গোয়েন্দা রিপোর্ট বলছে, ক্ষমতায় না এসেই বঙ্গ-বিজেপি নেতাদের বেপরোয়া ক্ষমতার দম্ভ প্রদর্শন, মানুষের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছিলো৷
◾বিজেপি’র গায়ে ‘বহিরাগত’ তকমা লাগিয়েছিলো তৃণমূল৷ সেটা জোরদার হয়েছে নেতাদের ভাষাগত সমস্যার কারণে৷ এই সমস্যাই বড় হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে রিপোর্টে। বাংলার মানুষ মনে করেছেন, বিজেপি মানেই অবাঙালি লোকজন।
এছাড়াও গোয়েন্দা রিপোর্টে বলা হয়েছে:
◾দলবদলুদের ‘দাপটে’ আরএসএস নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়৷ এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে৷
◾নির্বাচনে তহবিল ঠিক মতো ব্যবহার করা হয়নি বলেও উল্লেখ রয়েছে৷ এমনকি বহু প্রার্থী যে টাকা পেয়েছে, তার ৫০ শতাংশও খরচ করেনি।
বাংলায় হারের এই সব চাঞ্চল্যকর কারণের কথাই শাহের কাছে তুলে ধরেছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা ৷