প্রায় প্রত্যেকেরই দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিনী মন্দির দর্শনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। কিন্তু ক’জন জানি ১৮৫৫ সালের আজকের দিনে, অর্থাৎ ৩১ মে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রানি রাসমণি।
আজ, সোমবার দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দিরের ১৬৭তম প্রতিষ্ঠা দিবস। ১৮৫৫ সালের ৩১ মে বা ১৮ জ্যৈষ্ঠ, বৃহস্পতিবার ,পুণ্য স্নানযাত্রার দিনেই দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন রানী রাসমণি।

১৮৪৭ সালে এই মন্দির তৈরির কাজ শুরু হয়। এবং শেষ হয় ১৮৫৫ সালে। ১০০ ফুটেরও বেশি উঁচু এই নবরত্ন মন্দিরের গর্ভগৃহে সহস্রদল রৌপ্য-পদ্মের উপর শায়িত সদাশিবের বুকের উপর দেবী কালী অধিষ্ঠিতা। একখণ্ড পাথর দিয়ে তৈরি হয়েছে এই দেবীমূর্তি। মা ভবতারিণীর কষ্টিপাথরের মূর্তি তৈরি করেছিলেন বর্ধমান জেলার দাঁইহাটের অধিবাসী নবীন ভাস্কর।
করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালের ৩১মে, ১৬৬তম জন্মদিনে দক্ষিণেশ্বরের দরজা বন্ধ ছিল ভক্তদের জন্য। ২০২১ এও ১৬৭তম জন্মদিনে মন্দিরের দরজা বন্ধই থাকল ভক্তদের জন্য। দেশজুড়ে করোনার বাড়বাড়ন্তের জন্য রাজ্যে কার্যত লকডাউন। ভবতারিণীর করুণা থেকে বঞ্চিতই থাকলেন ভক্তরা, কারণ করোনা যে এখন মানুষের আতঙ্কের কারণ।

দেখে নেওয়া যাক এই বিখ্যাত মন্দির প্রতিষ্ঠার ইতিহাস
১৮৪৭ সালে শুরু হয় দক্ষিণেশ্বর মন্দির তৈরির কাজ। এই মন্দির তৈরির সম্পূর্ণ হয় ১৮৫৫ সালে। খরচ হয়েছিল ৯ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা যার মধ্যে শুধু উদ্বোধনের দিনই খরচ হয়েছিল দু’লক্ষ টাকা। তবে মন্দির উদ্বোধন নিয়ে বেশকিছু জটিল সমস্যা দেখা গিয়েছিল। দক্ষিণেশ্বর মন্দির উদ্বোধনের নিমন্ত্রণের চিঠি পেয়ে রামকৃষ্ণের দাদা রানীর প্রতিনিধিদের বলেন রানী কৈবর্ত জাতি। তার নিমন্ত্রণ ও দান গ্রহণ করলে তাকে ‘একঘরে’ হতে হবে। রানীর বিশ্বস্ত সুদক্ষ কর্মীরা তাকে বোঝান রানী কৈবর্ত নন, মাহিষ্য সম্প্রদায়ের। শেষ পর্যন্ত রামকুমার চট্টোপাধ্যায় রাজি হন এবং তার ভাইকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা দিবসের একদিন আগে দক্ষিণেশ্বরে উপস্থিত হন।
আরও পড়ুন-দক্ষিণেশ্বর মন্দির প্রতিষ্ঠালগ্নে ভীম নাগ থেকে নৌকা পথে গিয়েছিল তিন মণ মিষ্টি

রানি রাসমনি ছিলেন দেশপ্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাঁর ব্যক্তিত্বে ও চরিত্রে অসাধারণ শক্তি, তেজস্বিতা ও দৃঢ়তার সমন্বয় অনেক ক্ষেত্রেই কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছে। তাঁর মন্দির নির্মাণ নিছকই ধর্মক্ষেত্র প্রতিষ্ঠা নয়, মাতৃমুক্তির আন্দোলনের সর্বপ্রথম পদক্ষেপ। কলকাতার জানবাজার অঞ্চলের বিশাল জমিদারি এবং ভূ-সম্পত্তির মালিক ছিলেন রানি রাসমণি। বহু লোকহিতকর কাজের ফলে অল্পদিনেই হয়ে উঠেছিলেন প্রজাদের চোখের মণি।
সেবার রানী কাশী যাত্রা করবেন বলে ঠিক করেছিলেন, সব আয়োজন সম্পূর্ণ। যাত্রার পূর্বরাতে কালিকাদেবী জ্যোতির্ময়ী মূর্তিতে আবির্ভূতা হয়ে আদেশ দেন- “তোমার কাশী যাত্রার প্রয়োজন নেই, ভাগীরথীর তীরে আমার মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে পূজা ও ভোগের ব্যবস্থা করো। আমি ওই মূর্তিতে আবির্ভূতা হয়ে নিত্য পূজা গ্রহণ করব।” ভাগীরথীর তীরে যেস্থান রানীর পছন্দ হল তার একদিকে ক্রিশ্চান কুঠি, অন্যদিকে মুসলমানদের কবরস্থান ও গাজি পীরের আস্তানা। স্থানটির আকৃতি কূর্মপৃষ্ঠের মতন। এমন স্থানই শক্তিসাধনার উপযুক্ত। এখানেই দশ বছর ধরে রানি গড়ে তুলেছিলেন তাঁর সাধের সাধনপীঠ, দক্ষিণেশ্বর।
বিগত ১৬৭ বছর ধরে দক্ষিণেশ্বর মন্দির বাংলার ধর্ম ও সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে চলেছে। তখন ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ, রাসমণি, মা সারদা। ছিল খোলার চালের ঘর। ছিলনা শান বাঁধানো দালান, গঙ্গার ঘাট। গঙ্গার জোয়ারের সময় জল এসে আছড়ে পড়ত দ্বাদশ শিবমন্দিরের পিছনের দেওয়ালে। এখন গঙ্গার পাড় বাঁধিয়ে সংস্কার করা হয়েছে। উঠানের উত্তর-পশ্চিমে রামকৃষ্ণদেবের ঘর-এখানেই তাঁকে ঘিরে রাখতেন তখনকার দিকপালরা। অদূরেই নহবতখানা; সকাল-সন্ধে দুবার সানাইয়ের সুর ভাসিয়ে নিয়ে যেত মন্দির চত্বর। পরে এই নহবতই হয় সারদা মায়ের বাসস্থান, জীবন্ত শক্তিপীঠ। এখন সেখানে সারদা মন্দির। নহবতের পাশেই বকুলতলার ঘাট। শেষরাতে মা সারদা স্নান করতেন এখানে। এই ঘাটেই এসেছিলেন ভৈরবী যোগেশ্বরী, পরমহংসদেবের তন্ত্রসাধিকা। যে পঞ্চবটী রচনা করেছিলেন রামকৃষ্ণ স্বয়ং, সেখানে এখন বাঁধানো রাস্তা, সিমেন্টের বসার জায়গা। হারিয়ে গিয়েছে সেই ঘন জঙ্গল যেখানে বাহ্যজ্ঞানলুপ্ত হয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ সাধনা করতেন।
বর্তমানে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে তৈরি হয়েছে উন্নতমানের স্কাইওয়াক। মন্দিরের বছর পূর্তি উপলক্ষে বহু উন্নয়নমূলক কাজ করেছিল মন্দির কর্তৃপক্ষ। বাংলার ইতিহাসে ঐতিহ্যপূর্ণ মন্দির হিসাবে রানী রাসমনির প্রতিষ্ঠিত মা ভবতারিণীর মন্দির আজও সমাদৃত।










































































































































