এক বছর ধরে সময় নষ্ট করে এখন করোনা সংকট (covid crisis) ঘোরালো হতেই পরিস্থিতি মোকাবিলার দায় এড়িয়ে পালাতে চাইছেন নরেন্দ্র মোদি (narendra modi)। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণবাজির ফুলঝুরিতে চাপা দেওয়া যাচ্ছে না দেশজুড়ে করোনা মহামারির দ্বিতীয় দফার এই সংকটকে। বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা যখন দেশে করোনা দ্বিতীয় ঢেউয়ের পূর্বাভাস নিয়ে বারবার সতর্ক করছিলেন, তখন তাতে গুরুত্ব না দিয়ে প্রধানমন্ত্রী ব্যস্ত থেকেছেন ভোটপ্রচারের ডেলি প্যাসেঞ্জারিতে। বিধানসভা ভোটে যে তৎপরতায় তিনি বিভিন্ন রাজ্য, বিশেষত বাংলায় ভোটের রাজনৈতিক প্রচারে সময় ব্যয় করেছেন, তার অর্ধেক প্রশাসনিক তৎপরতাও তিনি দেখাননি করোনা অতিমারির দ্বিতীয় দফার প্রবল সংক্রমণ মোকাবিলার বন্দোবস্তে। ফলে রাজ্যে রাজ্যে এখন হাহাকার চলছে। ভ্যাকসিন, অক্সিজেন, ওষুধ, হাসপাতালের বেডের চূড়ান্ত অপ্রতুলতা। ফের আর একদফা অাতঙ্কের মুখে দেশের পরিযায়ী শ্রমিকরা। রাজধানী দিল্লিতে এমন অবস্থা যে মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে টুইট করে প্রাণ বাঁচানোর অক্সিজেন ভিক্ষে করতে হচ্ছে। তার মধ্যেও কুৎসিত রাজনৈতিক বৈষম্যের সাক্ষী থাকছে দেশ। দিল্লিতে অক্সিজেনের হাহাকার, অথচ বিরোধী সরকার বলে সেখানে যোগান না বাড়িয়ে চাহিদা ততটা না থাকা সত্ত্বেও যোগী আদিত্যনাথের কথায় উত্তরপ্রদেশে পাঠানো হচ্ছে অক্সিজেন সিলিন্ডার! অবস্থা দেখে চুপ থাকতে পারেনি দিল্লি হাইকোর্টও। মোদি সরকারকে কটাক্ষ করে বিচারপতিরা বলেছেন, দিল্লির মানুষ যখন পর্যাপ্ত অক্সিজেন পাচ্ছেন না তখন অন্য রাজ্যে অক্সিজেন পাঠানোর কাজ যারা করছেন তাদের হাতে রক্তের দাগ লেগে থাকছে। বিচারপতিদের আক্ষেপ, শিল্পসংস্থাকে অক্সিজেনের জন্য অপেক্ষা করতে বলা যায়, কিন্তু তা না করে একজন মুমূর্ষু মানুষকে অক্সিজেনের জন্য অপেক্ষা করে থাকতে হবে?
আরও পড়ুন-ওরা মন্দির-মসজিদ করেছে, মমতা করছেন উন্নয়ন: অভিষেক
করোনা মোকাবিলার নামে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে মোদি যা বললেন তা শুধু দ্বিচারিতায় ভরা তাই নয়, তাঁর সরকারের অপদার্থতা ও ব্যর্থতাও স্পষ্ট। গত বছর করোনা সংকটের গোড়ায় কয়েক ঘণ্টার নোটিশে লকডাউন ঘোষণা করে এই নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, লকডাউনই একমাত্র পথ। আমরা আঠেরোদিনে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধজয়ের মত এই লড়াই জিতব। আর সেই মোদির মুখেই এখন ১৮০ ডিগ্রি উল্টো কথা। তিনি এখন বলছেন, লকডাউন হল শেষ পথ। রাজ্যগুলিকে লকডাউন এড়িয়ে বিকল্প পথ ভাবতে হবে। তাই যদি হয়, তাহলে সেদিন আচমকা লকডাউন ঘোষণা করে দেশবাসীকে বিপদে ফেলেছিলেন কেন? লকডাউন ঘোষণার পর দেশের কয়েক কোটি দরিদ্র পরিযায়ী শ্রমিককে কী নরকযন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে তা গোটা দুনিয়া দেখেছে। লকডাউন শেষ পথ হলে সেদিন এই মানুষগুলোর কথা মনে হয়নি কেন? এখন প্রধানমন্ত্রী আবেদন করছেন, পরিযায়ী শ্রমিকরা যাতে যে যেখানে আছেন সেই শহর না ছাড়েন তা দেখতে হবে রাজ্য সরকারগুলিকে। কিন্তু প্রশ্ন, পরিযায়ী শ্রমিকরা এখন ফের কর্মহীন হলে শুধু রাজ্যগুলির উপর তা দেখার দায়িত্ব থাকবে কেন, কেন্দ্র কেন সাহায্য করবে না? রাজ্যগুলির উপর একতরফা আর্থিক দায় চাপানোর অর্থ কী? প্রধানমন্ত্রী মুখে পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য বড় বড় কথা বলছেন আর এদিকে তাঁর সরকারই চুপিসাড়ে প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ যোজনায় পরিযায়ী শ্রমিকদের বিনামূল্যে খাদ্যসামগ্রী বণ্টনের প্রকল্পটি বন্ধ করে দিয়েছে! এই সময় যখন করোনা সংকট আবার বাড়ছে তখন পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য নির্দিষ্ট করে কেন্দ্রীয় সহায়তার কথা প্রধানমন্ত্রী বললেন না কেন? সব দায় এখন রাজ্যের? আর কৃতিত্ব নেওয়ার বেলায় তিনি?
গত কয়েক মাস আগে প্রাকৃতিক নিয়মে যখন সব রাজ্যেই করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছিল তখন হাতে সময় পেয়েও ভবিষ্যৎ সংকটের কথা ভেবে হাসপাতালগুলির পরিকাঠামো বাড়ানোর কাজে মন দেননি প্রধানমন্ত্রী। ভ্যাকসিন নির্মাতা বা ওষুধ-অক্সিজেন সরবরাহকারী সংস্থাগুলির সঙ্গে আলোচনা করে ভবিষ্যৎ রূপরেখা ঠিক করে রাখেননি। অথচ বহু আগে থেকেই বিশেষজ্ঞরা ভারতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সতর্কবাণী দিচ্ছিলেন। শুধু বাংলা নয়, আরও একাধিক রাজ্য ভ্যাকসিন, ওষুধ, অক্সিজেন সময়মত মজুত করে রাখার অধিকার চাইছিল। পশ্চিমবঙ্গ সরকার শুরু থেকেই রাজ্যবাসীকে বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দেওয়ার লক্ষ্যে তা কিনতে চেয়ে অনুমতি চেয়েছিল। তখন তা নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য করেননি মোদি। উল্টে বিজেপি নেতারা প্রচার করছিলেন, ভ্যাকসিন বাংলায় বেশি পাঠালে অপচয় হবে! এখন কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্যই বলছে, দেশের মধ্যে করোনা ভ্যাকসিন অপচয় না করার শীর্ষে রয়েছে বাংলা। তার মানে এতদিন ধরে একদিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বাংলার বদনাম করা হল, আবার ভ্যাকসিন কম পাঠিয়ে বঙ্গবাসীকে বিপদের মধ্যেও ফেলল কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। এখন সব রাজ্যেই ভ্যাকসিনের চাহিদা তুঙ্গে। সংক্রমণ লাগামছাড়া হয়ে বিশ্বরেকর্ড ভাঙছে। বিপদ বুঝে মোদি এখন বলছেন, রাজ্যগুলি ভ্যাকসিন কিনে নিতে পারে! অর্থাৎ সংকট থেকে নিজে হাত ধুয়ে ফেলে রাজ্য সরকারগুলিকে চাপে ফেলার চেষ্টা। এই সিদ্ধান্তটা এখন নিলে দুমাস আগে নেননি কেন? দীর্ঘসময় ধরে দাবি তোলা হলেও সমস্যা হুড়মুড়িয়ে অাসার পর মোদি বলছেন, ১৮ থেকে ৪৫ বছর বয়সীরা টিকা নিতে পারবেন। কিন্তু সরকার বিনামূল্যে তাঁদের টিকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত না নেওয়ায় বিপুল সংখ্যক দরিদ্র মানুষ, পরিযায়ী শ্রমিকের টিকাকরণ অনিশ্চিত হয়ে গেল। আবার কেন্দ্র ভ্যাকসিন নির্মাতা সংস্থাগুলির কাছ থেকে যে দামে টিকা কিনেছে সেই চুক্তি রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে বলবৎ হবে না। সেক্ষেত্রে রাজ্য সরকারগুলিকে টিকা কেনার জন্য বেশি টাকা খরচ করতে হবে। সবমিলিয়ে বলা যায়, করোনা নিয়ে যেসময় দীর্ঘমেয়াদী নীতি-নির্ধারণ আর ভবিষ্যৎ সংকট মোকাবিলায় পরিকাঠামো তৈরির কথা ছিল, তখন নরেন্দ্র মোদি রাম মন্দির নির্মাণে ব্যস্ত ছিলেন। আর এখনও রামনবমীর আগে দেশবাসীকে করোনার প্রবল সংকটের মুখে দাঁড় করিয়ে কোনও দিশা দেখাতে না পেরে দায় এড়িয়ে পালিয়ে যাচ্ছেন।