
সুখেন্দু শেখর রায়
(সাংসদ, রাজ্যসভা)
গত নভেম্বরে অমিত শাহ বাংলায় এলেন। বললেন, মমতা সরকার কো ‘উখারকে ফেক দো’। জনগণের নির্বাচিত সরকারকে এইভাবে ফেলা যায় না। আমরা কখনও বলি না, মোদি সরকারকে উপড়ে ফেলে দাও। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, এরা গণতন্ত্র বা সংসদীয় ব্যবস্থায় বিশ্বাস করেনা। ভোটে জিতলে ভাল। নইলে সিবিআই, আয়কর, ইডি ইত্যাদি কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে কাজে লাগাও, এমএলএ কেনাবেচা কর, এমন জঘন্য স্বৈরতান্ত্রিক অভিযানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলে আনা ওদের মজ্জাগত হয়ে গেছে।
◾(২) এবার না’কি ওদের ‘টার্গেট’ বাংলার মানুষ। তাই বাংলাকে ৫টি জোনে ভাগ করে ‘বহিরাগত বর্গী’-রা সন্ত্রাসের মহড়া শুরু করেছে। উদাহরণ, শিলিগুড়ি, হালিশহর ও দক্ষিণবঙ্গের কয়েকটি জায়গা। তৃনমূলের কাঁধে দোষ চাপাতে শুরু হয়েছে গুপ্তহত্যা।
◾(৩) আমরা চাই, উন্নয়ণের মাপকাঠিতে প্রচার হোক, আর মানুষই তাদের নিজেদের সরকার নির্বাচিত করুন, যেমন বরাবর করে এসেছেন। বহিরাগত বর্গীদের অস্ত্রের ঝনঝনানির কাছে বাংলার মানুষ কিছুতেই মাথা নত করবেন না।
◾(৪) শ্লোগান ছিল, ‘স্বচ্ছ ভারত’। অথচ মোদি সরকারের সবই অস্বচ্ছতায় ভরা। যেমন, হাজার হাজার কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে বিজেপি রেকর্ড পরিমাণ তহবিল তৈরি করলো। কারা দিলেন? কেন দিলেন? বিনিময়ে দাতারা কী কী অনৈতিক সুবিধা পেলেন? জানান দেশের মানুষকে। তেমনই ‘পিএম কেয়ার্স ফান্ড’। কোনও হিসেব নেই, অথচ প্রধানমন্ত্রীর নামে বিপুল পরিমাণ টাকা তোলা হচ্ছে । আরটিআই করলেও জবাব পাবেন না। আসলে চুরির টাকার কী হিসেব দেওয়া যায়!
◾(৫) আমরা মনে করি, কেন্দ্রের মোদি সরকার এতাবৎ দেশের সবচেয়ে বড় ‘ধাপ্পাবাজ সরকার’। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, নোটবন্দির ১৫ দিনে কালো টাকা উদ্ধার করে সবার খাতায় ১৫ লাখ করে জমা করবেন। না পারলে চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে শাস্তি মাথা পেতে নেবেন। বলেছিলেন, বছরে ২ কোটি চাকরি দেবেন। এতদিনে তাহলে ১২ কোটি বেকারের চাকরি পাওয়ার কথা। পাওয়া তো দূরের কথা, শুধু এ বছরের এপ্রিলে ২ কোটি কর্মরত মানুষ কাজ হারিয়েছেন। কৃষকদের ফসলের দাম দ্বিগুণ করবে বলেছিলেন। অথচ, ৩টি কৃষি আইন গায়ের জোরে পাশ করিয়ে আদানি- আম্বানি ও বড় পুঁজিপতিদের জন্য কৃষিক্ষেত্র দখলের সুযোগ করে দিল, যার বিরুদ্ধে দেশের অন্নদাতারা দিল্লির উপকণ্ঠে তীব্র শীত উপেক্ষা করে কৃষিআইন বাতিলের দাবিতে তিন সপ্তাহ ধরে ধরণা দিচ্ছেন। শ্লোগান ছিল, সবকা সাথ, সবকা বিশ্বাস । আত্মনির্ভর ভারত। অথচ, ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামের পরিসংখ্যান অনুযায়ী (জানুয়ারি’২০) ভারতের ৭৩ শতাংশ সম্পদ, ১ শতাংশ বিত্তবানদের কব্জায়। বিশ্বব্যাঙ্কও অনুরূপ তথ্য দিয়েছে। সুতরাং ‘সব্ কে সাথ, সব্ কা বিকাশ’ নয়। এক পারসেন্টকে সাথ, এক পারসেন্টকা বিকাশ।’ প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, করোনা দূর করতে কয়েক সপ্তাহ সময় দিন, আর থালা-ঘন্টা বাজান। আজ ১০ মাস পরে দেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় এক কোটি ছুঁয়ে ফেলেছে। ওদের কেউ বললেন, গরুর চোনা খান, নয়তো ভাবী কা পাঁপড়৷ অপরিকল্পিত লকডাউন, স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর অপ্রতুলতা, নিয়মবিধি নিয়ে হাস্যকর গোঁয়ারতুমি, রাজ্যে রাজ্যে করোনা মোকাবিলায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করল। তাই কয়েক লক্ষ মানুষ প্রাণ হারালেন। এই মৃত্যু মিছিল চলছে।
◾(৬) কেন্দ্রের মোদি সরকার আসলে ‘বিক্রেতা সরকার’। ২৮টি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিক্রি পর্ব শুরু হয়েছে। এয়ার ইন্ডিয়া, বিপিসিএল, চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভ, সেল ইত্যাদি। শুধু আদানিই পেয়েছে ৬টি বিমানবন্দর, ঝাড়খণ্ডের ৩টি বিশাল কোল ব্লক, পোর্ট ট্রাস্টের হাজার হাজার হেক্টর জমি। অন্যান্য সমস্ত খনি খুলে দেওয়া হয়েছে দেশি-বহুজাতিক সংস্থার লুঠতরাজের জন্য।
◾(৭) বাদ যায়নি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের ‘বেঙ্গল কেমিক্যালস’। শীঘ্র দরপত্র চাওয়া হবে বিক্রির জন্য। আচার্য রায় তাঁর জীবনের সমস্ত সঞ্চয় উজাড় করে ১৯০০ সালে গড়ে তোলেন এই প্রথম কোনও স্বদেশি কারখানা। মাঝে রুগ্ন হয়ে পড়লেও এখন প্রতিবছর লাভ করছে। ২০২২-এর মধ্যে ‘মিনিরত্ন’ কোম্পানি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সুতরাং এটি অ-লাভজনক সংস্থা নয়। তবু কেন বিক্রি ? কারণ, বেঙ্গল কেমিকেলের ৪ জায়গায় কারখানা রয়েছে। মুম্বইয়ের প্রভাদেবী, কানপুর, সোদপুর ও বেলেঘাটায়। এই ৪টি কারখানার মোট জমির বর্তমান বাজার দর ১৫ হাজার কোটি টাকা। তাই বিক্রি ৷ আর এই সমস্ত কিছুই বিক্রি হচ্ছে ‘কাটমানি’ নিয়ে। মোদি সরকার তাই দেশের ঐতিহাসিক কাটমানি-র সরকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
◾(৮) বহিরাগত বর্গীরা রোজ পালা দিয়ে বাইরে থেকে গুন্ডা নিয়ে আসছে। প্রকাশ্যে খুন ও সন্ত্রাসের হুমকি দিচ্ছে। স্থানীয় এজেন্ট ও প্রতিবেশী রাজ্যের দাগীদের দিয়ে গুপ্তহত্যার পথ বেছে নিয়েছে।
◾(৯) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৯ বছরের শাসনে কোনও উল্লেখযোগ্য খুনখারাপি, দাঙ্গাহাঙ্গামা ঘটেনি, যা অবিরত ঘটেছিল বাম রাজত্বে। জঙ্গলমহল, পাহাড়সহ সর্বত্র শান্তির পরিবেশ বজায় রয়েছে। ধাপ্পাবাজি বা নরহত্যা নয়, শান্তি এবং উন্নয়ণ এবং ক্রমাগত উন্নয়ন মমতা সরকারের একমাত্র কর্মসূচি । তাই মা-মাটি-মানুষের সরকারের বিভিন্ন সফল কর্মসূচি আন্তর্জাতিক স্তরে প্রশংসিত হয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকারও স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছে। ভূভারতে অন্য রাজ্যের ক্ষেত্রে এমন কোনও নজির নেই।’সবার জন্য স্বাস্থ্য প্রকল্প’ সারা পৃথিবীতে একমাত্র বাংলার প্রাদেশিক সরকারই চালু করেছে। বিশ্বের কোনও প্রাদেশিক সরকার নয়, মাত্র ২/৩টি রাষ্ট্রে এই ব্যবস্থা চালু হয়েছে। ‘দুয়ারে সরকার’ কর্মসূচির মাধ্যমে মুখ্যমন্ত্রী যাবতীয় সরকারি প্রকল্পের সুফল, মানুষের দোরগোড়ায় পৌছে দেওয়া শুরু করেছে। সারাদেশে এর নজির নেই। অথচ, বহিরাগত বর্গীর দল ও তাদের স্থানীয় স্যাঙাতেরা বলছে, মানুষের দুয়ার নাকি ‘যমের দুয়ার’। মানুষকে অপমান করার এই দু:সাহসের জন্য বাংলার মানুষ ওদের উচিত শাস্তি দেবে।
◾(১০) প্রসঙ্গ, তৃণমূলের দলীয় কোন্দল৷ তৃনমূলে দলীয় কর্মসূচি বা নেতৃত্ব প্রসঙ্গে কারুর মনে কোনও দ্বিধা বা দ্বন্দ্ব নেই। ব্যক্তিগত স্তরে কোথাও যদি সামান্য ভুল বোঝাবুঝি ঘটে, তা সঙ্গে সঙ্গে সাংগঠনিক পদক্ষেপের মাধ্যমে নিরসন করা হচ্ছে ৷ তবে কেউ যদি প্রবল উচ্চাকাঙ্খী হন অথবা চিটফান্ড বা অন্য আর্থিক কেলেঙ্কারির সঙ্গে যুক্ত থাকেন, তাদের ওরা ভয় দেখাতেই পারে, ‘হয় দলে এসো, নাহলে যাও জেলে’। ইতিমধ্যে এমন কলঙ্কিতরা তো বিজেপিতে শুধু যোগ দিয়েছেন তা নয়, নানা পদে আসীনও হয়েছেন।

































































































































