আলাদা দল’ই গড়ছেন শুভেন্দু, ঘোষণা নিয়ে ধন্দ, কণাদ দাশগুপ্তর কলম

0
3
কণাদ দাশগুপ্ত

১৯৯৮ সালের ১ জানুয়ারি বাংলায় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ভেঙে তৈরি হয় তৃণমূল কংগ্রেস৷

২০২১-এর ওই একইদিনে তৃণমূল কংগ্রেস ভেঙে সম্ভবত আর একটি নতুন দল ঘোষণা হতে চলেছে৷ শুভেন্দু অধিকারীর শিবির যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েই ওই তারিখ নিয়ে আলোচনা করছে৷ সম্ভবত এমনই হতে চলেছে৷ সূত্রের খবর এমনই৷

বেশ কিছুদিন ধরেই নিজের অবস্থান নিয়ে রহস্য বাড়িয়ে চলেছেন শুভেন্দু অধিকারী৷ এখনও পর্যন্ত স্পষ্ট করেননি নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ৷ নানা জল্পনা ভেসে উঠেছে৷ কেউ বলছেন, সদলবলে বিজেপিতে যোগ দিতে চলেছেন শুভেন্দু৷ অন্য বার্তা আসছে, তিনি নিজেই দল ঘোষণা করবেন৷

খুবই স্বাভাবিক এই চর্চার মাঝে নির্ভরযোগ্য সূত্রের খবর, সরাসরি বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন না নন্দীগ্রামের তৃণমূল বিধায়ক৷ আলাদা দল ঘোষণা করতে চলেছেন৷ সেই ঘোষণা কবে হবে, কে ঘোষণা করবেন, শুভেন্দু নিজে, না’কি তাঁর ঘনিষ্ঠ কোনও নেতা, তা নিয়ে চূড়ান্ত স্তরের আলোচনা চলছে৷ যে কোনও সময়েই এই ঘোষণা প্রকাশ্যে আসবে৷ কারন, তৃণমূলও বসে নেই৷ গত শনিবার থেকে পূর্ব মেদিনীপুরে শুভেন্দু- অনুগামী ব্লক সভাপতিদের দলীয় পদ থেকে অপসারণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে৷ এতদিন কিছুটা দলের লাগাম থাকলেও, এবার ওইসব অপসারিত নেতারা হাত-পা ঝাড়া হয়ে ‘দাদা’র সঙ্গে প্রকাশ্যেই এখন যোগাযোগ রাখা শুরু করে দিয়েছেন৷

শুভেন্দু-ঘনিষ্ঠ সূত্রের খবর, তৃণমূলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং পরবর্তী রাজনৈতিক পদক্ষেপের প্রশ্নে ‘দাদা’ অনুসরণ করতে চাইছেন ১৯৯৮ সালে কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপায়ের গ্রহণ করা পথ৷ সেই সময় কংগ্রেস নেত্রী মমতা, কংগ্রেস দল থেকে ইস্তফা দিয়ে ঘোষণা করেছিলেন আলাদা দল৷ ১৯৯৮ সালের ১ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় তৃণমূল কংগ্রেস ৷ পরে বিজেপির সঙ্গে আসন সমঝোতা করে তৃণমূল লড়াই করে লোকসভা নির্বাচনে ৷

শুভেন্দুও নাকি একই পথে হাঁটতে চলেছেন৷ তৃণমূলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা আগে করলেও ২০২১-এর ১ জানুয়ারির আগে তিনি নতুন দল ঘোষণা করার কথা না’কি ভাবছেন না৷ দল ঘোষণার পর শুভেন্দুর দলও বিজেপির সঙ্গে আসন সমঝোতা করেই বিধানসভা নির্বাচনে লড়াই করবে, এমনই ভাবনা রয়েছে শুভেন্দু-শিবিরের৷ তবে চর্চায় আছে, নতুন ওই দল আনুষ্ঠানিকভাবে কে ঘোষণা করবেন ? শুভেন্দু অধিকারী নিজেই একথা জানাবেন ? না’কি শুভেন্দুর সঙ্গে যেতে পারেন এমন এক বা একাধিক ‘চমক’ দেওয়া নেতা শুভেন্দুর তরফে এই ঘোষণা করবেন ? সূত্রের খবর, ইতিমধ্যেই তৃণমূলের এমন কিছু নেতা বা বিধায়ক সরাসরি শুভেন্দুর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন, যারা দলত্যাগ করলে, ভোটের মুখে কিছুটা হলেও অস্বস্তিতে পড়তে পারে শাসক দল৷ তবে সবটাই চলছে নীরবে, গোপনে৷ অনেকক্ষেত্রে গোপনীয়তার মোড়ক এতটাই পোক্ত যে, ইঙ্গিত পাওয়া তো দূরের কথা, আঁচও করতে পারছে না শাসক দল৷ ঠিক যেমন ঘটনা মঙ্গলবার ঘটে গিয়েছে তৃণমূল সাংসদ সুনীল মণ্ডলের ছবি সম্বলিত পোস্টার প্রকাশ্যে আসার পর৷ ওই পোস্টার এবং পোস্টার-প্রসঙ্গে সাংসদের প্রতিক্রিয়া, নিশ্চিতভাবেই উদ্বেগ বাড়িয়েছে শাসক শিবিরের৷

আরও পড়ুন- ৯ জানুয়ারি আইলিগের প্রথম ম‍্যাচ, প্রথম ম‍্যাচে মহামেডানের মুখোমুখি সুদেভা এফসি

অন্যদিকে পুরুলিয়ায় এবং নন্দীগ্রামে ইতিমধ্যেই শুভেন্দু- অনুগামীরা ‘মাঠে নামা’র বার্তা দিয়ে পৃথক কার্যালয় খুলেছেন৷ পুরুলিয়া শহরের ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের সরকারপাড়ায় ‘দাদার অনুগামী’দের নতুন কার্যালয় চালু হওয়ার পর, নন্দীগ্রামের রেওয়াপাড়ায় চালু হয়েছে অনুগামীদের দ্বিতীয় কার্যালয়৷ ওই সব অনুষ্ঠানে ছিলেন জেলা তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক, জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক, পুরসভার কাউন্সিলর-সহ দলের একাধিক পদাধিকারী। এমন আরও বেশ কিছু কার্যালয় বিভিন্ন জেলায় চালু হতে চলেছে৷ প্রস্তুতি সম্পূর্ণ ৷ নতুন কার্যালয় চালু করা নিয়ে শুভেন্দু- অনুগামীদের বক্তব্য, “মানুষের জন্য কাজ করতে হবে। এখনও আমরা দলে থাকলেও দলীয় কার্যালয়ে গেলে কেউ কেউ সন্দেহের চোখে দেখছিলেন। তাই আলাদা কার্যালয়ের খুব দরকার হয়ে পড়েছিল।” শোনা যাচ্ছে, কলকাতাতেও কার্যালয় চালু করার কথা ভাবা হচ্ছে৷ জেলায় জেলায় আলাদা কার্যালয় চালু করার অর্থও একটাই, বিজেপিতে নয়, নিজের দল ঘোষণাই করছেন নন্দীগ্রামের বিধায়ক৷ বিজেপিতে গেলে তো ওই দলের ‘রেডিমেড’ অফিসই ব্যবহার করতে পারতো ‘দাদার অনুগামীরা’৷ তেমন হচ্ছে কোথায় ? জানা গিয়েছে, কলকাতার একাধিক নেতাও না’কি শুভেন্দুর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন৷ অনুগামীরা এমনই দাবি করছেন৷

রাজনৈতিক মহলের বিশ্লেষণ, বডি ল্যাঙ্গুয়েজে ‘কুছ পরোয়া নেহি’ ভাব দেখালেও শুভেন্দু-ইস্যুতে ঘাসফুল শিবিরের অস্বস্তি একাধিক৷ দলে থাকা অবস্থায় দলের শীর্ষস্তরকে এর আগে কেউ এভাবে বিড়ম্বনায় ফেলতে পারেনি৷ অথচ দল কোনও পদক্ষেপ করতে পারছেনা ৷ শুভেন্দু এখনও পর্যন্ত দল বা দলনেত্রী-বিরোধী একটা কথাও বলেননি৷ এমন কৌশল যদি তিনি বজায় রাখেন, তাহলে শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে তাঁকে বহিষ্কার করা কঠিন৷ তবে দলে থাকলেও শুভেন্দু যে দলের কাজকর্ম করবেন না, শীর্ষনেতৃত্ব তা জানে৷ মেদিনীপুরে মমতার সভাতেও শুভেন্দু অনুপস্থিত ছিলেন৷ তবুও তাঁকে সরাসরি কিছু বলার সুযোগ দলের হাতে নেই৷
শুভেন্দু দল ছাড়লে তৃণমূলের যে ক্ষতি হবে, তা আরও স্পষ্ট হয়েছে শাসক দলের শীর্ষস্তরের কিছু তৎপরতা প্রকাশ্যে আসার পর৷ শুভেন্দুর সঙ্গে শীর্ষনেতাদের সর্বশেষ এবং বহুচর্চিত বৈঠকটির কথা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ্যে আনেন তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়৷ বৈঠকে কারা কারা ছিলেন, সেই সব নাম-ধামও জানান সৌগতই৷ উল্টোদিকে শুভেন্দু এখনও পর্যন্ত একটা শব্দও উচ্চারণ করেননি৷ শুভেন্দু-শিবির নিয়ে যে সব কথা ভেসে বেড়াচ্ছে, তার অধিকাংশই জল্পনা৷ তৃণমূলেরও উচিত ছিলো তাদের ‘শুভেন্দু-নীতি’ গোপন রাখা৷ বহুচর্চিত ওই বৈঠকের কথা, বৈঠকের সাফল্য বা ব্যর্থতার কথা এভাবে হাটের মাঝে উপুড় করে দিয়ে সৌগত রায় নিজেই ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে ‘হিরো’ বানিয়ে দিয়েছেন শুভেন্দু অধিকারীকে৷ পাশাপাশি তৃণমূলের ইমেজে ‘দুর্বলতা’-র ছাপ লাগিয়েছেন৷ এতজন হেভিওয়েট ‘পাকা মাথার’ নেতাদের ওই সিদ্ধান্ত কতখানি সঠিক হয়েছে, প্রশ্ন উঠেছে, তা নিয়েও৷ জানা নেই, সৌগতবাবুর এই ভূমিকার পিছনে কোনও ‘চাপ’ কাজ করেছে কি’না৷

ওদিকে তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় বা পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম প্রায় রোজই বার্তা দিচ্ছেন,
‘তৃণমূল ছেড়ে গিয়ে কেউই বিশেষ সুবিধা করতে পারবেন না৷’ শুভেন্দু- ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য, ‘ওনারা দলের নির্দেশেই এসব বলছেন৷ এতে কোনও অন্যায় নেই, ভুলও নেই৷ প্রদেশ কংগ্রেসের মেগাওয়েট নেতারা তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠালগ্নে ঠিক এমন কথাই তো বলতেন’৷

মোটের উপর, শুভেন্দু অধিকারী এবং তৃণমূলের তথাকথিত ‘বিক্ষুব্ধ’দের ঘিরে রাজনৈতিক মহলে জল্পনা বেড়েই চলেছে। শুভেন্দু অধিকারী নিজে যতক্ষণ না মুখ খুলছেন, ততক্ষণ এ জল্পনার অবসানের কোনও সম্ভাবনাই নেই৷

আরও পড়ুন- বনধ উপেক্ষা করে কোচবিহারে আন্দোলন স্বাস্থ্য কর্মীদের