কিশোর সাহা
সাড়ে তিন বছর পরে নিজের জেলায় পা দিয়েই ভিড়ে ঠাসা সভায় নরেন্দ্র মোদিকে পর্যদুস্ত করার ডাক দিয়ে আগামী নির্বাচনের প্রচার শুরু করে দিলেন গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার নেতা বিমল গুরুং। রবিবার সন্ধ্যায় শিলিগুড়ি শহরের গান্ধী ময়দানে দলীয় জনসভায় গুরুং বলেন, “আমাদের গোর্খাল্যান্ডের আবেগ নিয়ে যাঁরা ভোট হাসিল করেছে তাঁদের উচিত শিক্ষা দেওয়ার সময় এসে গিয়েছে। এক দশকের বেশি সময় ধরে প্রতিটি ভোটেই আমরা বিজেপিকে সমর্থন করেছি। গোর্খাদের দাবি, আবেগকে মর্যাদা দেওয়ার কথা খোদ নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন। কাজের কাজ কিছু হয়নি। আমি সাড়ে তিন বছর ধরে নিজের জেলাতেই ফিরতে পারিনি। এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৌজন্যে ফিরতে পেরেছি। উনি যা বলেন তা করেন।”
এর পরেই সুর সপ্তমে তুলে সমর্থকদের উদ্দেশে গুরুংয়ের বার্তা, “আগামী লোকসভা ভোটে নরেন্দ্র মোদিকে আমাদের শক্তি বুঝিয়ে দিতে প্রতিটি ভোট ব্যবহার করতে হবে। শুধু গোর্খা নন, আদিবাসী, রাজবংশী সহ সকলকেই বিজেপির বিশ্বাসভঙ্গের হিসেব বুঝে নিতে হবে।”
এদিন গুরুংয়ের সভায় পৌঁছনোর কথা ছিল বেলা ১২টার মধ্যেই। কিন্তু, মালদায় ঝাড়খণ্ড দিশম পার্টির রেল অবরোধের জেরে দার্জিলিং মেল আটকে পড়ে। তার পরে পুলিশের সহায়তায় বেলা প্রায় ৪টে নাগাদ গুরুং সভাস্থলে পৌঁছান। ততক্ষণে পাহাড়, তরাই ও ডুয়ার্সের মোর্চা সমর্থকদের ভিড়ে ময়দানে পা ফেলার জায়গা নেই। ইতিমধ্যে বক্তৃতা দিয়েছেন রোশন গিরি, দীপেন মালে সহ মোর্চার প্রথম সারির নেতারা।
প্রায় আধ ঘণ্টার বক্তৃতার গোড়া থেকেই গুরুংয়ের সুর ছিল চড়া। তিনি আগাগোড়াই বিজেপির বিরুদ্ধে বার্তা দিয়েছেন। এবাবেই তিনি যে লাগাতার ভোটের প্রচার চালিয়ে যাবেন সে কথাও মঞ্চ থেকে জানিয়ে দিয়েছেন। তবে অনেকে ভেবেছিলেন গুরুং মঞ্চ থেকে বিনয় তামাং, অনীত থাপাদের বিরুদ্ধে সুর চড়াবেন তা অবশ্য হয়নি।
গুরুং জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি পাহাড়ে না থাকলেও পাহাড়বাসী, তরাই ও ডুয়ার্সের মানুষ যে তাঁর আর্জিতে সাড়া দিয়েছেন সেটা গত লোকসভা ভোট ও বিধানসভার উপনির্বাচনে স্পষ্ট হয়েছে। গত লোকসভায় রেকর্ড ভোটে দার্জিলিং থেকে বিজেপির প্রার্থী রাজু বিস্ত জিতেছেন। পরে দার্জিলিং বিধানসভা উপনির্বাচনে জিটিএ-এর প্রাক্তন কেয়ারটেকার চেয়ারম্যান বিনয় তামাংকে বিজেপি প্রার্থী নীরজ জিম্বা হারিয়েছেন। পাহাড়ের মানুষের সমর্থন শুধু নয়, তরাই ও ডুয়ার্সের ১৫টি আসনে নেপালি ভাষীরা যে তাঁর আর্জি মেনে ভোট দিয়েছেন সেই দাবির যৌক্তিকতা বোঝাতে গত লোকসভার ফলাফলের কথা উল্লেখ করেছেন।
তথ্য-পরিসংখ্যান দেওয়ার পরে গুরুং জানান, আগামী লোকসভা ভোটে বিজেপির সঙ্গে হিসেব বুঝে নিতে হবে। গুরুংয়ের আর্জি, দার্জিলিংয়ের তিনটি আসন তো বটেই, সমতলের শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, মলবাজার, মাটিগাড়া-নকশালবাড়ি, ডাবগ্রাম ফুলবাড়ি, বীরপাড়া-বানারহাট, কালচিনি, আলিপুরদুয়ার, রাজগঞ্জ সহ ১৩টি আসনে বিজেপির বিরুদ্ধে তাঁদের সমর্থকদের প্রতিটি ভোট ব্যবহার করতে হবে।
ঘটনাচক্রে, গুরুংয়ের সভার দিকে নজর ছিল তৃণমূল, বিজেপি সহ সব দলেরই। দীর্ঘ সময় পরে গুরুং ফেরার পরে এতটা জনজোয়ার হওয়ায় বিজেপির নেতাদের অনেকেই নেপালি ভাষী এলাকায় আগামী ভোটে কেমন ফল হতে পারে তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। কীভাবে পাহাড়, তরাই ও ডুয়ার্সে নতুন জোটসঙ্গী মিলতে পারে সেই প্রচেষ্টাও শুরু হয়েছে বিজেপির অন্দরে।
তৃণমূল শিবির অবশ্য অনেকটাই উদ্দীপিত। কারণ, বিনয় তামাং, অনীত থাপাদের অনুগামীরা সঙ্গেই রয়েছেন। জিএনএলএফও এখনও বিজেপির দিকে ঝোঁকেনি। সর্বোপরি, বিমল গুরুংয়ের জনপ্রিয়তা যে পাহাড়-তরাই-ডুয়ার্সে গোর্খাল্যান্ডের দাবিদারদের কাছে এতটুকুও কমেনি সেটাও স্পষ্ট হওয়ায় তৃণমূলের প্রাথমিক হিসেব মিলেছে।
যদিও আগামী বিধানসভা ভোটের পরে বিমল গুরুংরা ফের গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে সরব হলে কী হবে সেই প্রশ্ন অবশ্য রয়েছে। তবে গুরুং জানিয়ে দিয়েছেন, বাংলার সঙ্গে বিরোধের রাস্তায় হেঁটে তাঁরা কোনও আন্দোলন করবেন না।
একনজরে বিমল গুরুংয়ের বক্তব্য:
১) প্রতিটি ভোটে আমাদের আবেগকে মর্য়াদা দেওয়া হবে বলে বিজেপি প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু, পরে বিজেপি ভুলে গিয়েছে। এভাবে আমাদের ঠকানোর বদলা নিতেই প্রতিটি ভোট ব্যবহার করতে হবে নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে।
২) আমাদের বিশ্বাসভঙ্গের প্রতিশোধ নিতে প্রতিটি ভোট ব্যবহার করতে হবে রাজু বিস্তদের বিরুদ্ধে।
৩)পাহাড়-তরাই-ডুয়ার্সের আবেগ নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে যে বিজেপি তাদের আগামী লোকসভা ভোটে উচিত শিক্ষা দিতে আমরা প্রতিটি ভোট ব্যবহার করব।
৪) সাড়ে তিন বছর বাইরে ছিলাম কিন্তু পাহাড়-তরাই-ডুয়ার্সই ছিল আমার মনপ্রাণ জুড়ে।
৫) এতদিন পরে নিজের জায়গায় ফিরতে পারলাম তার কারণ হল মমতা ব্যানার্জি। তাঁকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
৬) আমরা বাংলার রীতি-ঐতিহ্য-আবেগের কথা মাথায় রেখেই সব কাজ করব।
৭) গোর্খাল্যান্ডের দাবি থেকে আমরা সরছি না। কিন্তু, বাংলার কোনও মর্যাদাহানি করে কিছু করব না।
৮) গত সাড়ে তিন বছর পাহাড়ে যাঁরা উন্নয়নের কাজকর্মের দায়িত্ব পালন করেছে তাঁরা কতটা কী কাজ করেছে তা নিয়ে পাহাড়ের মানুষেরই সংশয় রয়েছে। বাংলার সরকার বহু টাকা দিয়েছে তা কোথায় গিয়েছে দেখতে হবে। আর আমরা অন্তরালে থাকলেও গত তিন বছরে সব কটি ভোটে আমরা যে দলকে সমর্থন করেছি তারাই পাহাড় ও লাগোয়া নেপালি ভাষী অধ্যুষিত এলাকায় বিপুল ভোটে জিতেছে।
৯) আমি আমৃত্যু পাহাড়-তরাই-ডুয়ার্সের জন্য কাজ করে যাব।
১০) মমতা ব্যানার্জি যা বলেন তা করে দেখান, তাই তাঁর উপরে আমরা ভরসা রাখতে পারি।