নানা সময়ে নানা সাক্ষাতকারে অনেক কথা বলেছিলেন প্রবাদপ্রতিম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ৷ এই সব কথনে যেন এক অন্য সৌমিত্র উঠে আসে৷ অভিনেতার পাশাপাশি কখনও দার্শনিক, কখনও কবি, কখনও বা বিদ্রোহীজন৷
সেইসব সাক্ষাতকার থেকে বাছাই করা কিছু ‘সৌমিত্র-কথন’৷

⬛ এই বুড়ো বয়সে নিজের ইমোশনগুলোকে কনট্রোল করা মুশকিল হয়ে যায়। মনে হতে থাকে, সত্যি সত্যি কী এমন করেছি যে, বাঙালি আমায় এত ভালবাসে? নিজের জীবনটা তখন আত্মানুসন্ধান করতে, ভাবতে শুরু করি। কিছুই তো পারিনি। জীবনটা কি তা হলে বাজেই গেল?
অ্যালবার্ট সোয়াইৎজারের কথা মনে হতে থাকে তখন। তিনি পরিপূর্ণ শিল্পী-জীবনকে এক কথায় ত্যাগ করে আফ্রিকার লেপার্ড-অধ্যুষিত জঙ্গলে সমাজসেবার জন্য চলে গিয়েছিলেন। কত বড় স্যাক্রিফাইস। এটা আমি করতে পারলে মনে হত জীবনটা সার্থক। তার মুরোদ তো আমার নেই। তখনই মানুষের যা নেচার,আমি সেলফ জাস্টিফিকেশন খুঁজতে থাকি। আমি নিজের সঙ্গে প্রায়ই কথা বলি। নিজেকে বলি, এই যে এত কিছু করলে, এ সব কেন? তুমি পাশ দিয়ে গেলে ওই যে ছেলেগুলো আজও চিৎকার করে, দ্যাখ, দ্যাখ, স-উ-মি-ত্র স-উ-মি-ত্র যাচ্ছে, তার জন্য তো নয়। এটা নিশ্চয়ই লক্ষ্য ছিল না? আমি তো চেয়েছিলাম, আমি হেঁটে গেলে লোকে বলবে, ওই যে যাচ্ছে! ওর মতো অভিনয় কেউ করতে পারে না। আদারওয়াইজ এই জীবনের কী মানে? মানুষের কী উপকার করতে পারলাম? তখন নিজেকে বোঝাই, অভিনয়ের মাধ্যমে যেটুকু আনন্দ বিতরণ করতে পেরেছি, সেটাও তো এক অর্থে মানুষের সেবা। সেটাও তো একটা উপকার।

⬛ আমি মনে করি জাস্ট রিমেইনিং অ্যালাইভটা কোনও জীবন নয়। ইফ ইউ আর নট বিয়িং কালচারালি অ্যালাইভ। ইফ ইউ আর নট বিয়িং ক্রিয়েটিভলি অ্যালাইভ। ইফ ইউ আর নট বিয়িং ক্রিটিক্যালি অ্যালাইভ। তা হলে তুমি বেঁচে নেই। আমার কাছে সেটা জীবন নয়। তা হলে তুমি জাস্ট শারীরিক ভাবে বেঁচে আছ। যেটা আমার কাছে মূল্যহীন।
একটা কথা বুঝতে হবে,
আমি কোনও টাকাই করতে পারিনি। টাকার দিকে তাকালে আমার চোখ চকচক করেছে সব সময়। কিন্তু কী করে যে টাকা করব, সেটা তখনও বার করতে পারিনি। যৌবনে আসলে একটা ভ্রান্ত ধারণাও ছিল যে টাকাটা গৌণ। ক্রিয়েটিভ স্যাটিসফ্যাকশন’ই আসল। এটা প্রায় গভীর বিশ্বাসে ঢুকে গিয়েছিল। ‘টাকা মাটি, মাটি টাকা’ তো অসামান্য এক ফিলোজফি। যার অর্থ বেশির ভাগ মানুষ ধরতে পারে না। এটা ঠিকই যে, ভ্রান্ত একটা বিশ্বাস চালাত। তারপর যখন রিয়্যালিটিটা বুঝতে পারলাম৷

⬛ একটা খুব সত্যি কথা বলি। আমি এখানে একজন সোশ্যাল আইকন। সে ভাবেই আমাকে দেখা হয়। আমি বিয়েবাড়িতে কোনও গিফট দেওয়া মানে, লোকে উল্টেপাল্টে দেখে সৌমিত্র চাটুজ্জে কী দিল দেখি তো। অথচ আমার সোশ্যাল স্টেটাস আর ইকোনমিক স্টেটাসের মধ্যে ভয়ঙ্কর বৈপরীত্য। বাঙালি আমাকে যত শ্রদ্ধার চোখেই দেখুক, তীক্ষ্ণ বাস্তব হল, কলকাতা শহরের কর্পোরেট দুনিয়ার হাজার হাজার কর্মী আমার চেয়ে বেশি রোজগার করে। আমাকে তো জীবনধারণের জন্য কাজ করে যেতেই হবে।

⬛ আমি বলব, লাইফ ইজ দ্য আনসার টু লাইফ। আমার জীবনই জীবনের উত্তর। আর কিছু নয়। এটা আমি বারবার বলে এসেছি। এখনও একই কথা বলব।

⬛ পরজন্মে বিশ্বাস করতে পারলে ভাল হত। কিন্তু এখনও তার প্রমাণ পাইনি। তাই নিজের সঙ্গে সমঝোতা করতে হয় যে একটাতেই সব শেষ। তবু ওপরে গিয়ে যদি বেঁচে থাকা বলতে কিছু থাকে, তাহলে প্রথমে
দেখা করতে চাই, আমার বাবা’র সঙ্গে৷ তিনিই আমার প্রকৃত শিক্ষাগুরু। আমার পরম বন্ধু। আমার প্রেরণা। ওঁর সঙ্গে দেখা করার পর সত্যজিৎ রায়। তার পর শিশির ভাদুড়ি, ভানুদা (ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়) -কে খুঁজব। তারপর অবশ্যই উত্তমকুমার৷ আমার ভীষণ বড় বন্ধু ছিল। দাদা ছিল। তার চলে যাওয়া যে মৃত্যুশোক দিয়ে গেছে তার সঙ্গে বোধহয় আর কিছুই তুলনীয় নয়। রবি ঘোষও আছে। কিন্তু আমি চাইব, যাদের সঙ্গে এ জীবনে দেখা হয়নি, তাদের সাগ্রহে মিট করতে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর! আহা, যদি একবার রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করা যায়!

⬛ সুচিত্রা সেন আমার চেয়ে বয়সে বড়। এমন একটা বয়সে উনি পৌঁছে গিয়েছিলেন, যাকে বলা যেতে পারে মৃত্যুর অবধারিত বলয়। উনি নিজেই যোগাযোগ রাখতেন না। আমার ধারণা, শেষ দিকে উত্তমদার সঙ্গেও ওঁর যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে আসে। শেষ দিকটা কিছু বোধহয় মনোমালিন্য হয়েছিল দু’জনের। আমি অবশ্য আমার মেয়ের বিয়ের নেমন্তন্ন করতে একবার সুচিত্রা সেনের বাড়িতে গিয়েছিলাম। সেটা ওঁর সঙ্গে পনেরো বছর পর দেখা।

⬛ আমার ক্যানসার ডিটেক্টেড হওয়াটা একটা ভয়ানক ধাক্কা। আমার বন্ধুরা শক খাওয়ার মতো তখন বলেছিল, কী রে পুলু বলছিস কী! আমার দাদা প্রচণ্ড আপসেট হয়ে গেলেন। এদের আতঙ্কিত হাবভাব দেখে আমি আরও নার্ভাস হয়ে গেলাম। মৃত্যু তো জানিই, একদিন যেতে হবে। কিন্তু ক্যানসার মানে তো প্রচণ্ড যন্ত্রণা দিয়ে মৃত্যু। মনে মনে ভাবলাম, আমি এর কাছে সাবমিট করব? এই রোগটাকে শিরোধার্য করব? করলে তো হয়েই গেল। তার চেয়ে ফাইট করে দেখি না। আমার আশ্রয় এ সব জায়গায় একমাত্র আমিই হতে পারি। ঠিক করলাম, যা থাকে কপালে, আমিই লড়ব। কোনির একটা বিখ্যাত সংলাপ আছে, যা প্রায় আইকনিক হয়ে গিয়েছে। খিদ্দা বলছে, ‘‘ফাইট কোনি, ফাইট।’’ আমিও চূড়ান্ত বিপর্যয়ে নিজেকে বলি, ফাইট, সৌমিত্র ফাইট।

⬛ একটা মৃত্যুচিন্তা হয়৷ অবশ্যই হয়। নিয়মিত ভাবে হয়। প্রতিদিনই তো প্রায় মৃত্যুসংবাদ পাই৷ আমার নৈমিত্তিক ব্যাপার। সকালে ফোন এলেই ভয় হয়, আবার বোধ হয় কোনও মৃত্যুসংবাদ এল। এই তো আজ সকালেই আমার বন্ধু অশোক পালিত ফোন করল। বলল, ‘‘হ্যাঁ রে পুলু, দ্বিজেন (নাট্যশিল্পী) নাকি খুব অসুস্থ!’’ আমি বললাম হ্যাঁ, অসুস্থ ছিল বেশ। এখন বেটার। তবে শুনেছিস তো নলিনী মারা গেছে। নলিনীর সঙ্গে আমরা সেই সময় কফি হাউসে আড্ডা মারতাম। অশোক বলল, হ্যাঁ, পেয়েছি। এ রকমই সব দৈনন্দিন আদানপ্রদান হতে থাকে। আমি-আমরা এখন আসলে সব পুরনো প্যান্টের ছেঁড়া পকেট। পকেট ঝাড়লে টাড়লে তামাকের টুকরো আর ছেঁড়া কাগজ ছাড়া কিছু বেরোয় না।মৃত্যুসংবাদগুলো হল এক-একটা ছেঁড়া কাগজ।
[ তথ্য: বিভিন্ন পত্রপত্রিকা থেকে ]
আরও পড়ুন-“আমি আছি সবার মাঝে যারা আমায় ভালোবাসো”, ফেসবুকে তাপসের স্মৃতি আঁকড়ে নন্দিনী

































































































































