
বাংলায় একুশের মহারণ মোটামুটি মাস ছয়েক দূরে৷ তার আগেই জানা যাবে বিহারের মসনদ কাদের দখলে গেলো৷ বোঝা যাবে ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড, বাংলার পর এবার বিহার পূর্ব ভারতে কোন বার্তা দিচ্ছে৷ প্রতিবেশী রাজ্যের ভোটের ফলাফল বঙ্গ- রাজনীতির একাধিক ওঠাপড়ায় যে প্রভাব ফেলবে, তা একরকম নিশ্চিত৷ রাজ্য-রাজনীতির শাসক-বিরোধী, প্রায় সব কুশীলবই এখন চোখ রেখেছেন বিহারের দিকে৷ আগামীদিনে বিহারের শাসক কারা হবেন, তার উপরই অনেকাংশে নির্ভর করছে এ রাজ্যের শাসক তৃণমূল বা প্রধান বিরোধী বিজেপির ঘর গোছানো পর্ব৷
সন্দেহ নেই, বিহারে বিজেপি-জেডিইউ-র প্রত্যাবর্তন ঘটলে বাংলায় এক ধাক্কায় অনেকটা এগিয়ে যাবে বিজেপি৷
তৃণমূল ছেড়ে বিজেপির দিকে পা বাড়ানো নেতারা প্রবল স্বস্তিতে ‘দলবদল’ করবেন৷ তাঁদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ এবং মুখের ভাষায় বদল স্পষ্ট হবে৷ তাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়বেন তৃণমূল নিধনে৷ সম্ভাব্য ‘দলবদলুরাও’ তাই বিহারের ভোটের ফলের দিকে চোখ রাখছেন।

রাজভবনে বসে রাজ্যপাল বাড়তি এনার্জিতে তোপ দাগবেন নবান্নকে লক্ষ্য করে৷ কেন্দ্রের শাসক দলের চতুর্থ স্তরের নেতানেত্রীরাও ‘বিপ্লবী’ হয়ে উঠবেন৷ তৃণমূলকে ব্যস্ত থাকতে হবে ঘর আগলাতে৷ তৃণমূলের ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোরের দিকে দলের অন্দর থেকেই আরও বেশি আঙুল উঠবে৷ কংগ্রেসের ফল বিহারে লজ্জাজনক হলে, এ রাজ্যের ভোটে মাথা তোলাই সমস্যাজনক হবে৷ সিপিএমের কথা এখানে বলা বা না-বলা, দুই-ই সমান৷ বিহারের মহাজোটে সিপিআই-এমএল ১৯ আসনে, সিপিআই ৬ আসনে লড়লেও সিপিএম প্রার্থী দিয়েছে মাত্র ৪টি আসনে৷ ভোট বিশ্লেষকরা বলছেন, বিহারে সিপিএমের খাতা খোলা কার্যত অসম্ভব৷ বাংলায় হ্যাটট্রিক করতে নামা তৃণমূলের কাছে তাই বিহার ভোটের ফলাফল অতীব গুরুত্বপূর্ণ৷
আর বিহারে বিজেপির স্বপ্নভঙ্গ হলে প্রথমেই যেটা হবে, তা হলো বাংলায় এসে প্রধানমন্ত্রী- স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর গগণভেদী আওয়াজ তোলা অনেকটাই থমকে যাবে৷ প্রধানমন্ত্রীর বিশ্বাসযোগ্যতা, গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে আরও একবার প্রশ্ন উঠে যাবে৷ এমনও হতে পারে, মোদিজি-শাহজি বাংলায় যতবার ভোটপ্রচারে আসবেন, ততই আসন কমবে বিজেপির৷ বঙ্গ-বিজেপির অন্দরের ফাটল আরও চওড়া হবে৷
এবং তৃণমূল ভেঙ্গে যে সব রথী-মহারথী বিজেপিতে যাওয়ার সলতে পাকাচ্ছেন, তাঁরা হঠাৎই বলতে শুরু করতে পারেন, “আমরা দলের নিষ্ঠাবান সৈনিক৷ আমাদের নামে মিডিয়া গুজব রটাচ্ছিলো৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া আমরা কিছু বুঝিনা৷ মমতাদির নেতৃত্বেই তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসবে তৃণমূল”৷ এটা নিশ্চিত, পাটনা’র পট-পরিবর্তন হওয়ামাত্রই বিজেপির শীর্ষমহল এখন যাদের জামাই-আদর করে ঘরে তোলার ছক সাজাচ্ছেন, সেই সম্ভাব্য জামাইদের অনেকেই ‘বিয়ে ভেঙ্গে’ দেবেন৷ বিপাকেই পড়তে হবে ‘কন্যাদায়গ্রস্ত’ গেরুয়া-পিতাদের৷
এবং সবথেকে বড় ‘বিপদে’ পড়বেন ধনকড় সাহেব৷ এরপর তৃণমূলের ব্লকস্তরের নেতাদের বাক্যবাণের মোকাবিলা করা একসময়ের ব্যর্থ রাজনীতিক ধনকড়ের পক্ষে সামাল দেওয়া সম্ভব নাও হতে পারে৷
বিহারের দু’পর্বের ভোট এবং সব দলের প্রচারের ধরন স্পষ্টতই বুঝিয়ে দিয়েছে, প্রবল চাপে আছে গেরুয়া-জোট৷ জোটের ‘মহাতারকা প্রচারক’ নরেন্দ্র মোদি বিহারে যেভাবে ‘ওয়ান-পয়েন্ট’ কর্মসূচিতে আক্রমণ হানছেন আরজেডি’র বছর তিরিশের সেনাপতি তেজস্বী যাদবকে, তাতেই বোঝা যাচ্ছে, এই লড়াই তাঁর অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রাখার৷ তেজস্বী যাদব এবারের ভোটে প্রমান করেছেন, ঘরে বসে সোশ্যাল-মিডিয়া সর্বস্ব রাজনীতিকদের মানুষ চায়না৷ নিজের নিরাপত্তার কথা না ভেবে মাত্র বছর তিরিশের তেজস্বী চষে ফেলছেন গোটা বিহার৷ আজকাল তো পাড়ার নেতারাও কেন্দ্রীয় বা রাজ্যের নিরাপত্তারক্ষীর ঘেরাটোপ ছাড়া বাথরুমেও যেতে চাননা৷ নিরাপত্তারক্ষীর সংখ্যার উপর আজকাল নির্ধারিত হয়, তিনি কততো বড় নেতা৷ প্রহরীবেষ্টিত হয়ে, সামনে-পিছনে হুটার বাজিয়ে জেলার সাজানো মঞ্চে উঠে ভাষণ দিয়েই যারা স্বঘোষিত ‘শীর্ষনেতা’ হয়েছেন, তাদের গালে থাপ্পড় মেরে বিরোধী দলে থাকা তেজস্বী যাদব প্রতি পদে বুঝিয়ে দিচ্ছেন, কেন তাঁকে এতখানি ভয় পাচ্ছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী এবং বিহারের মুখ্যমন্ত্রী৷ এমন লড়াকু তরুন রাজনৈতিক চরিত্র এই মুহুর্তে গোটা দেশে দ্বিতীয় একজনও নেই৷
বিহারের ভোটে হারলে নিশ্চিত ভাবেই বঙ্গ-বিজেপির ফুলে ফেঁপে ওঠা মনোবল তলানিতে ঠেকবে৷ কথায় কথায় ‘দিল্লির জুজু’ দেখানোর বৃত্ত সংকুচিত হবে৷ কারন, দিল্লির ওই তথাকথিত জুজুদের পাত্তাও দেননি বিহারের সাধারন মানুষ৷
বাংলার মানুষই বা দিতে যাবে কেন ? আসলে
বঙ্গ-বিজেপি মূলত দাঁড়িয়ে আছে দিল্লির খুঁটিতে হেলান দিয়ে৷ দিল্লির বিজেপি বার বার বুঝিয়েছে, বাংলার কোনও নেতার উপর ন্যূনতম আস্থা বা ভরসা তাঁদের নেই৷ দলকে এ রাজ্যে ক্ষমতায় আনার যোগ্যতা বঙ্গ-বিজেপির তথাকথিত ‘হেভিওয়েট’ নেতাদের একজনেরও নেই৷ তাই প্রতিটি ধাপে ‘পর্যবেক্ষক’ পাঠিয়ে দিল্লি চালাচ্ছে নজরদারি৷ সঙ্গে মোটা দাগের সঙ্গত করানো হচ্ছে রাজ্যপালকে বিজেপির আর একজন বিশেষ পর্যবেক্ষক বানিয়ে৷ আর সেই দিল্লিই যদি বিহারে নড়বড়ে হয়ে যায়, তাহলে বঙ্গ-বিজেপি কোন খুঁটির জোরে ভোট ময়দানে নামবে ?
বঙ্গ-বিজেপির নেতারাও নিশ্চয়ই বিহার ভোট নিয়ে ভাবছেন৷ বিহার হাতছাড়া হলে এখনও স্বাবলম্বন অর্জন না করা বাংলার নেতাদের যে ভরাডুবি হতে পারে, এমন আশঙ্কাও নিশ্চয়ই করছেন৷ বিহারের মসনদে তেজস্বী যাদব এলে রাজ্য বিজেপির হাতে একমাত্র অস্ত্র থাকবে বাংলায়
রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করে ভোটে যাওয়া৷
বিহারের দেওয়াল লিখন ক্রমশই স্পষ্ট হয়ে উঠছে৷ বঙ্গ-বিজেপির নেতারা বরং আর সময় নষ্ট না করে সেই রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করার কাজেই খোলাখুলি আত্মনিয়োগ করুন৷ তৃণমূলের এতবড় উপকার ইদানিং কালে আর কোনও দলই তো করেনি, বিজেপিই শুরু করুক৷
আরও পড়ুন-তেজস্বীতেই নড়বড়ে মোদি, কী হবে মমতায়? কণাদ দাশগুপ্তর কলম
































































































































