
বিহারের মসনদের লোভ, বলিউডের দু-একজন বিজেপি-পন্থী মহাতারকাকে বাঁচানো এবং মহারাষ্ট্রের অ-বিজেপি সরকারকে হুমকির মধ্যে রাখতে এক বাঙালি ব্রাহ্মণ-কন্যাকে আজ Scapegoat বানিয়ে শূলে চড়াচ্ছেন যারা, বাংলার ভোটে এই কাজের খেসারত দিতে তারা কতখানি তৈরি ? এখন থেকেই সেভাবে নিজেদের তৈরি না রাখলে, আঘাতটা বেশি লাগতে পারে৷
এই মুহুর্তে হেফাজতে থাকা রিয়া চক্রবর্তী ঠিক কি অপরাধ করেছেন?
আদালতে NCB রিয়া’র বিরুদ্ধে নিষিদ্ধ মাদক দ্রব্য বিক্রি, ব্যবহারের জন্য মাদক দ্রব্য সরবরাহ, মজুত রাখা বা উৎপাদন করা, অল্প পরিমাণ নিষিদ্ধ মাদক দ্রব্যের মজুত বা ব্যবহারের অভিযোগ এনেছে৷ এই অভিযোগ প্রমানিত হলে অবশ্যই রিয়ার শাস্তি হবে, কিন্তু এসবের সঙ্গে ‘সততার প্রতীক’ সুশান্ত রাজপুতের মৃত্যুর সম্পর্ক কোথায় ? কোন বৃহত্তম অপরাধ ঢাকা দিতে আজ রিয়া চক্রবর্তীকে বলির পাঁঠা বানানো হচ্ছে ? রিয়ার আইনজীবী সতীশ মানেশিন্ডে আদালতে বলেছেন, “বিচারের নামে প্রহসন চলছে। ২৮ বছরের এক মহিলাকে কাঠগড়ায় তোলার জন্য তিনটি কেন্দ্রীয় সংস্থা ঝাঁপিয়ে পড়েছে। রিয়ার দোষ একটাই, তিনি একজন মাদকাসক্ত এবং মানসিক সমস্যায় ভোগা মানুষকে ভালোবেসেছিলেন। সেই ব্যক্তি কেন নিষিদ্ধ ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করলো, তার তদন্ত কে করবে? কবে করবে?”
একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ আইনজীবী আদালতে এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ আনলেন সুশান্তের বিরুদ্ধে, তা একেবারেই মনগড়া, ভিত্তিহীন ? অসংখ্য মানুষের ধারনা, জাতীয়স্তরে বড়সড় এক রাজনীতির শিকার হয়েছেন রিয়া চক্রবর্তী ৷
আরও পড়ুন- বিদ্রোহের ভয়ে সুশান্ত ঘোষের শাস্তির খবর নেই দলীয় মুখপত্রে, কণাদ দাশগুপ্তর কলম
যে কোনও মৃত্যুই দুর্ভাগ্যজনক, সুশান্ত রাজপুতের মৃত্যুও তাই৷ তবে বলিউডের এই প্রয়াত অভিনেতা এই মুহুর্তে রাজনীতির বোড়ে হয়ে গিয়েছেন৷ তাঁর ছবিকে সামনে রেখে, তাঁর ছবি এবং বিজেপির প্রতীক দিয়ে পোস্টার-স্টিকার ছড়িয়ে খুল্লাম খুল্লা বিহারের ভোটপ্রচারে নেমেছে বিজেপি৷ বিহারের ভোটে জিততে বিজেপি সুশান্ত- আবেগকে ক্যাশ করতে চাইছে বিজেপি৷ জীবিত সুশান্তকে যারা চিনতোই না, চিনলেও যারা পাত্তা দিতো না, তাদের কান্না আর থামছেই না৷

প্রশ্ন আছে একাধিক৷ সুশান্ত রাজপুত মারা গিয়েছেন বলেই তিনি ধোয়া তুলসি পাতা হয়ে যাবেন, এ আবার কেমন কথা ? সুশান্ত সিং রাজপুতের নামে অনেক কথাই ইদানিং শোনা যাচ্ছে৷ বিয়ের পরের বছরই ডিভোর্স করেছে, গাঁজা খায়, ড্রাগ নেয়, রিয়া চক্রবর্তীর সঙ্গে লিভ-ইন চালানোর সময়ই সারা খানের সঙ্গে ব্যাঙ্ককে গিয়ে এক সপ্তাহ কাটিয়ে এসেছে, এমন হাজারো অভিযোগ আছে৷ আরও ভয়ঙ্কর অভিযোগও উঠে এসেছে একাধিক সংবাদ মাধ্যমে ৷ সে সব পরে বলা যাবে৷ আর সেই সুশান্ত এখন হঠাৎ হয়ে গেল সন্ন্যাসী-সম৷ বিশেষ একদিকে হেলে থাকা কিছু মিডিয়া তো সুশান্তকে “যুবসমাজের প্রতীক”-ও বানিয়ে ছেড়েছে৷ কেন? এসব অভিযোগের তদন্তের দাবি কেন করছে না বিজেপি ?
NCB মঙ্গলবার রিয়া’কে গ্রেপ্তার করেছে, আদালত তাঁকে ১৪ দিনের জেল হাজতে পাঠিয়েছে। এতে অনেকেই খুশি হয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় তুলেছেন৷ এই অংশের খুশি হওয়ার পিছনে রাজনীতি কাজ করছে৷ রাজনীতি এটাই, ‘Justice for Sushant’-র মোড়কে বিহারের ভূমিপুত্রের মরনোত্তর আবেগকে EVM-এ বন্দি করে বিহারের মসনদে গেরুয়া-পতাকা তোলা৷ সেই আবেগে সুড়সুড়ি দিতে হলে কাউকে কাঠগড়ায় তুলে দাবি করা যায়, “এই দেখো, আমরা সুশান্তের মৃত্যু মেনে নিইনি৷ আমরা বিচার চাইছি, আমরা অপরাধীর শাস্তি চাইছি”৷ সুশান্ত’র মৃত্যু নিয়ে অবশ্যই একটা রহস্য তৈরি হয়েছে৷ সেই রহস্য ভেদ করার দায়িত্ব CBI-কে দেওয়া হয়েছে৷ মনের মাধুরী মেশানো গল্পে বাজার গরম হতেই পারে, বাস্তব কিন্তু তা নয়৷ এখনও সেই তদন্ত শেষ হয়নি, এখনও জানা যায়নি সুশান্ত আত্মঘাতী হয়েছেন, না, খুন হয়েছেন৷ ফলে, রিয়া চক্রবর্তীর প্ররোচনাতে সুশান্ত আত্মহত্যা করেছেন, না’কি, রিয়া-ই খুন করেছেন সুশান্তকে, তা এখনও স্রেফ পরিকল্পনামাফিক কল্পনা৷ তাহলে কিছু মানুষ এত উল্লসিত কেন ?
আসলে রাজনীতির স্বার্থেই দরকার ছিলো একটা বলির পাঁঠা৷ তা খুঁজে পাওয়া গিয়েছে৷ নাম রিয়া চক্রবর্তী৷ এই রিয়ার
আসল বাড়ি বাংলার পুরুলিয়া জেলার সুইসা’য়৷ রিয়া বা তাঁর ভাই শৌভিক বাংলায় জন্মগ্রহণ না করলেও তাঁদের বাবা ইন্দ্রজিৎ চক্রবর্তী ছোটবেলা কেটেছে পুরুলিয়াতেই৷ রিয়াদের তুনতুড়ি গ্রামের বাড়িতে নাটমন্দির আছে, সেখানে আজও দুর্গাপুজো হয়৷ গ্রামের মানুষ ভিড় করে এই পুজো দেখতে৷ এই জেলার বাঘমুন্ডির তুনতুড়ি রাজদরবারে প্রভাবশালী পদে ছিলেন রিয়া-র পূর্বপুরুষরা৷ ছিলেন রাজার দেওয়ান৷ সুইসা’য় এখনও যথেষ্ট প্রতিপত্তি আছে চক্রবর্তীদের৷ উচ্চশিক্ষিত প্রায় সবাই৷ এই মুহুর্তে চক্রবর্তী পরিবারের অনেকেই বিভিন্ন রাজ্যে সরকারি আমলা-সহ বিভিন্ন উচ্চপদে চাকরি করছেন৷ পুরুলিয়ায় এই চক্রবর্তী পরিবার যথেষ্টই বর্ধিষ্ণু, অভিজাত এবং এখনও এলাকায় প্রভাবশালী ৷ রিয়া-র গ্রেফতারের খবরে সুইসা গ্রাম বিস্মিত, মানতেও নারাজ, তাদের গ্রামের মেয়ে রিয়া এ ধরনের অপরাধে যুক্ত৷ এদের সংখ্যাগরিষ্ঠের ধারনা, ‘রাজনীতি এখানে বড় ভূমিকা পালন করেছে৷ বিহারের সুশান্ত রাজপুতকে নিয়ে নাচানাচি করে কাদের লাভ, সেটা জানা দরকার’৷
সুশান্ত’র মৃত্যুর পরই ঠিক কোন কোন ধরনের কথাবার্তা ভেসে উঠেছিলো, তা আজ ভুলে গেলে চলবে কেন ? প্রথমেই একটি বিশেষ মহল থেকে তোলা হলো মুম্বইয়ের খান গ্যাং-এর কথা৷ ফোকাস করা হলো শাহরুখ, সলমান, আমির খানদের৷ এ নিয়ে আজ আর কেউ কথা বলছে না৷ এরপর ভাসানো হলো ‘নেপোটিজম’ তত্ত্বকে৷ প্রশাসন থেকে রাজনীতি, গান-বাজনা থেকে খেলাধুলো,এদেশের সর্বস্তরেই যেখানে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ‘নেপোটিজম’, সেখানে বলিউডেও যে ‘নেপোটিজম’ থাকবে, তা নিয়ে আকাশ থেকে আছাড় খাওয়ার অর্থ কী ? তবে এই প্রসঙ্গও বেশিদিন টিঁকলো না৷ এবার এসেছে নারকোটিক-চক্র৷ মুম্বই চলচ্চিত্র দুনিয়া যেন এই প্রথম শুনলো ওখানে গাঁজা-ভাঙ -নিষিদ্ধ ড্রাগের ব্যবহার হয়৷ নাটকের একটা সীমা আছে৷ বিহার ভোট পর্যন্ত সুশান্ত নিয়ে দাপাদাপি চলবে৷ ভোট মিটলে সুশান্তের পরিবার আজকের ‘রুদালি’-দের কতজনকে পাশে পায়, সেটাই দেখার৷
বাস্তব এটাই, স্রেফ রাজনীতির স্বার্থেই দরকার ছিলো একটা বলির পাঁঠা৷ এক বিশেষ চক্র তা খুঁজে পেয়েছে৷ ভবিষ্যৎ বলবে, ‘জাস্টিস ফর রিয়া’ জাতীয় কিছু ভাবা দরকার কি’না !
আরও পড়ুন- মোদি-ইমেজ অতীত, বিহারে বিজেপির মুখ সুশান্ত রাজপুত, কণাদ দাশগুপ্তর কলম



































































































































